থ্যাংকু রবিঠাকুর

 

কতরকম স্বপ্নই যে লোকে দেখে। সুখের, দুঃখের।
আমার সবথেকে সুখের স্বপ্ন কী তা কিছুতেই মনে থাকে না। ঘুম ভাঙার পর শুধু মনে পড়ে ভালো একটা কিছু দেখেছি। দাঁত মাজতে গিয়ে বাথরুমের আয়নায় দেখি একচিলতে হাসি লেগে আছে ঠোঁটের কোণে।
আমার দুঃখের স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন হল বাংলা পরীক্ষা। পরীক্ষায় দেরি করে পোঁছেছি। ঘণ্টাখানেক পরে হলে ঢুকে আবিষ্কার করি পকেটে পেন নেই। নয়ত দেখা গেল ব্যাকরণের প্রশ্নগুলো সব অজানা। অথচ এমনটা হবার কথা নয়। স্কুলে যখন পড়তাম আর কোনও পরীক্ষা ভালো হোক বা না হোক, বাংলায় আমি বরাবর ভালো করতাম। বলা হয়, আমাদের অবচেতন আমাদের স্বপ্নে উঠে আসে। কী করে যে বাংলা পরীক্ষা অবচেতনে আমার দুঃস্বপ্ন হয়ে গেল সেটাই ভেবে পাই না।

তা যে জন্যে এত কথার অবতারণা। গতকাল রাতে ভালো করে ঘুম হয়নি বলে আজ সকাল সকাল চাড্ডি ডাল-ভাত পুদিনার আচার দিয়ে খেয়ে ঘুমোতে না ঘুমোতেই আমাদের গ্রামের কোনও একটা অনুষ্ঠানে ঝাঁ করে পৌঁছে গেলাম। ম্যারাপ-ট্যারাপ বেঁধে একেবারে জমকালো ব্যাপার। লোকে লোকারণ্য। মাইকে ঘন ঘন ঘোষণা হচ্ছে। কী বলা হচ্ছিল তা ঠিক করে শোনার আগেই দৃশ্যান্তর। স্বপ্ন দেখার পর ঘুম থেকে উঠে মনে করতে গেলে নেহাতই স্মৃতি ফাস্ট ফরোয়ার্ড হয়ে যায়। তাই হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করলাম মাইকের সামনে। আমার পেছনে ক্যয়ারের স্টাইলে দু সারি ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে। উচ্চতা আর বয়স দেখে মনে হল স্কুলেই পড়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাদের দেখছি, এমন সময় পাঁজরে খোঁচা। পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের গ্রামের স্কুলের পিটি স্যার। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তাড়া লাগালেন – “জাতীয় সঙ্গীত শুরু করো।” আমি জনগণ-র জ উচ্চারণ করেছি কি করিনি; আবার খোঁচা – “সারে জাঁহাসে আচ্ছা-টা গাও।” শুনে আমার জ ঝুলে পড়ল। সারে জাঁহা সে আচ্ছা আবার কবে থেকে জাতীয় সঙ্গীত হল?
স্বপ্নে যুক্তি নিজের নিয়মে কাজ করে। তাই ঝট করে মনে পড়ল, এখন তো রবি ঠাকুরের গান ট্রাফিক সিগনালে লটর-পটর হয়ে আম জনতার জুলফি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, তাই বোধ হয় বঙ্গে আর রবি ঠাকুরের গান জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদায় নেই। যাই হোক, সামনে অগণিত শ্রোতা বসে। কায়দা করে সারে জাঁহা সে আচ্ছা শুরু করতে গিয়ে দেখি গলাটা নেহাতই করাতের মত খ্যাস-খ্যাস করছে। পেছন থেকে ছেলেমেয়েগুলো কোরাসে গাইছে বলে আমার গলাটা সেভাবে বোঝা যাচ্ছে না। এর মধ্যেই আর এক বিপদ টের পেলাম। পরের লাইনগুলো কিছুতেই মনে পড়ছে না। একসময় পেছনের কোরাস শেষ হল। আমি দুরুদুরু বুকে গাইতে লাগলাম – মাজহাব নেহি শিখাতা… একবার গাইলাম, দুবার গাইলাম। দুরাশা, যদি ফট করে মাথায় আসে পরের লাইনটা। কিন্তু আমার বিপদ বুঝেও পেছন থেকে কেউ পরের লাইনটা ধরিয়ে দিচ্ছে না। হয়ত ওরা নিজেদের বরাদ্দ চার লাইনের বেশি জানেও না। স্কুলের পর ধরেবেঁধে লেবু চায়ের লোভ দেখিয়ে এর থেকে বেশি আর কতটাই বা শেখানো যায়! সামনের জনসমুদ্রে হালকা হাসাহাসি শুরু হয়েছে। নিরুপায় হয়ে মাইকে হাত চাপা দিয়ে স্টেজের উইং-এ দাঁড়িয়ে থাকা পিটি স্যারকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম – “পরের লাইনটা কী?” বিপদ বুঝে তিনি তড়িঘড়ি এসে আমার কাঁধ ধরে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। টানাটানিতে মাইকটা চোঁয়াক করে উঠল।
স্টেজ থেকে নেমে একটু দূরে গিয়ে আমার বেইজ্জতির কথা ভাবতে শুরু করলাম। এক তো ধরে-টরে স্টেজে তুলে দেওয়া। তারপর জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে মশকরা। আর শেষে ঘাড় ধরে নামিয়ে দেওয়া। ব্রহ্মতেজ থাকলে এখনই কটমট করে তাকিয়ে দিতাম এই অভদ্রদের মঞ্চ ভস্ম করে।

“কিছু একটা হলেই আগুন লাগানোটা আজকাল রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
আচমকা এমন মর্মভেদী মন্তব্যে চমকে উঠে দেখি তিনি পাশে দাঁড়িয়ে। লম্বা জোব্বা, সুন্দর চুল, রুপোলি দাড়ি। সেই প্রথম দেখার পর থেকে নয় নয় করে পঁচিশ বছর পেরিয়ে গেছে, রবি ঠাকুরের বয়স এখনও একটুও বাড়েনি। কিন্তু এ্যাদ্দিন তো শুধু ছবিতে দেখা। সামনাসামনি রক্তমাংসের ঠাকুরের সাক্ষাত এই প্রথম। আনন্দের ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই দেখি আমার ব্যাঙ্গালোরের ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেছি।
আমার বসার ঘরটা বেশ বড়সড় হয়ে গেছে (লোকজনকে বলার সময় যতটা বড় বলি, তারই কাছাকাছি)। আর কোত্থেকে এসে জুটেছে দুটো টুল। একটাতে তিনি বসে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন – “বোসো।” দ্বিধায় পড়ে আমি অন্য টুলটাতে বসব নাকি ওনার পায়ের কাছে মেঝেতে বসব ভাবছি, উনি ছেলেমানুষের মত জিজ্ঞাসা করলেন – “আমার লেখা পড়েছ তুমি?” আমি একগাল হেসে গদগদ হয়ে বললাম – “পড়েছি। প্রায়ই পড়ি।” তারপর একটু ভেবে বললাম – “আপনার উইট আর হিউমার যা। মানে অন্য সবকিছুও ভালো… তবে…” উনি আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন – “তুমিও লেখো?”
আমি ঘাড় নাড়লাম।
“গল্প না কবিতা?”
আমি বুক ঠুকে বললাম – “দুটোই।”
“কই দেখি তোমার গল্প পড়াও। দেখি কেমন উইট আর হিউমার শিখেছো তুমি।”
আমি ধাঁ করে ‘নতুন কবিতার কবি’ বইটা ওনার হাতে দিলাম। তারপর পাশের টুলে বসে দেখতে লাগলাম আমার বই পড়ে মুচকি মুচকি হেসে ঘাড় নাড়ছেন তিনি।
“বাহ! বেশ লেখো তো তুমি।”
আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। এ্যাদ্দিন আমি রবি ঠাকুর পড়েছি। আর আজ রবি ঠাকুর আমায় পড়ছেন।

robi_thakur_dream

আমাদের অবচেতন আমাদের স্বপ্নে উঠে আসে এমনটাই যদি মেনে নিই, তাহলে মানতেই হবে রবি ঠাকুর একদিন আমার লেখা পড়বেন এমনটা মনের কোণেই লুকিয়ে ছিল কোথাও। এত জটিলতা, ব্যস্ততা আর বকমবাজির চাপেও এই ছেলেমানুষিটা কী করে যেন টিকে গেছে।
ঘুম ভাঙার পর মুখ ধুতে গিয়ে বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি, ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি লেগে আছে।

1
16 Comments
  • Keya
    June 9, 2014

    ‘আজ রবি ঠাকুর আমায় পড়ছেন’…দারুণ উপভোগ্য লেখা, সঙ্গে বাড়তি পাওনা চমৎকার কার্টুন। খুব ভাল লাগল।

  • Sanhita
    June 9, 2014

    নতুন পাগলামির পাগল 🙂

  • ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
    June 9, 2014

    অত্যন্ত সাবলীল লেখা- স্বপ্ন নিয়ে নানা ভাষায় কিছু লেখা মাঝে মাঝে মাঝে পড়ি- ইংরেজি অনুবাদ-যেমন পড়ি ভৌতিক গল্প- রোহনের লেখার ভক্ত আমি- সব থেকে ভাল লাগে পরিমিতি বোধ তথা মাত্রাজ্ঞান। আরও লেখো রোহন- আরও পড়াও।

  • দেবজ্যোতি
    June 9, 2014

    ভালো লাগল। কল্পনার লাগামটাকে ভালোভাবে ছাড়তে হলে ক্যালি লাগে। আরো ক্যালি লাগে আমার ভাষায় তিক্ততা, সমালোচনা ও মেসেজহীন ফুরফুরে লেখা বানাতে। সকালবেলা এ লেখাতে সেইটে পেয়ে গেলাম। লেখককে ধন্যবাদ।

  • Golam Rashid
    June 9, 2014

    ‘Notun Kobitar Kobi ‘amio porlam.ami actually ‘Humayun-groher’basinda.onno boi porte geley alissi ase.kintu sotti abar abiskar korlam notun golper golpokar.

  • kausik bhaduri
    July 9, 2014

    keno jani na amar swopno ba du;swopno-o sei bangla poriksha! sei byakoroN! 1st paper -e kobita mukhostho lekha, 4 nomborer proshno!

    • rohonkuddus@gmail.com
      July 9, 2014

      কৌশিকদা, আমরা হাওড়ার লোক কিনা, তাই এত মিল। 😛

  • কৌশিক ভাদুড়ী
    July 9, 2014

    “নতুন কবিতার কবি”র পড়ার পরে আমার এত ভালো লেগেছিলো, লেখককে টেলিফোন করে জানিয়েছিলাম।

    • rohonkuddus@gmail.com
      July 10, 2014

      মনে আছে। 🙂

  • sahabaj alam
    October 21, 2014

    Golpo ta pore mone hochea sopno jodi sopner moto hoi tahole tar anondo ta oi sokaler hasir moto sobsomoi lege thakbe.

  • Sikta Das
    March 26, 2016

    ভাগ্যিস কিছু স্বপ্ন দেখা এমন মধুর হয়। খুব ভালো লাগলো। তোমার আঁকা দেখেও মুগ্ধ হই রোহণ। শুভেচ্ছা

    • rohonkuddus@gmail.com
      March 26, 2016

      থ্যাংকু। থ্যাংকু। 🙂

      তোমাকেঅ শুভেচ্ছা।

  • Rananya
    March 26, 2016

    দারুণ লাগল রোহনদা।
    আজি হতে শতবর্ষ পরে
    রবি ঠাকুর পড়িছে বসে তোমার লেখাখানি

    • rohonkuddus@gmail.com
      May 14, 2016

      হা হা হা… এটা ভালো বলেছ 😀

  • Shree Shambo
    March 26, 2016

    ‘ঘুম ভাঙার পর মুখ ধুতে গিয়ে বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি, ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি লেগে আছে’- এই হাসিটুকুর জন্যই বেঁচে আছি… উপভোগ করলাম।

    • rohonkuddus@gmail.com
      May 14, 2016

      ওই হাসিটুকু বেঁচে থাকার অনেকটাই। ঠিকই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *