আমার দাদির গল্প এর আগে কেন কেউ লেখেনি সেটাই আশ্চর্যের।
মাঘ মাসে রাতদুপুরে বাপি যখন বায়না করত খেজুর গুড় দিয়ে চিতাও পিঠে খাবে, তখন দাদি যা করত তা গল্পই বটে। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে উঠে গায়ে কোনওরকমে চাদরটা জড়িয়ে নিয়ে হ্যারিকেন হাতে দাদি ঢুকত রান্নাঘরে। তারপর একচুলো ধরিয়ে শুরু হত পিঠে বানানো। ছ্যাঁত ছ্যাঁত আওয়াজে পাশের তালগাছের মামদো ভাবত বুঝি পাকান বানানো হচ্ছে। একবার রান্নাঘরের জাফরির ফাঁক থেকে লম্বা হাত বাড়িয়ে বলেওছিল – “এঁকটাঁ পাঁকাঁন দেঁ।” মামদোর সঙ্গে নাকি কথা বলতে নেই। তাহলেই সে তোমায় বশ করে নেবে। তাই দাদি একচুলোর উনুন থেকে চুপচাপ একটা জ্বলন্ত কাঠ তার হাতে তুলে দিয়েছিল। মামদো ‘জ্বঁলেঁ গেঁলুঁম, মঁরে গেঁলুঁম’ করে সেই যে তালগাছে গিয়ে উঠেছিল আর কখনও নামেনি। শুধু ভাদ্রমাসে তাল পাকলে আমাদের ভাঁড়ারঘরের চালের ওপর তাল ছুঁড়ে মেরে টালি ভাঙত।
যাই হোক, পিঠে বানানো শেষ হলে দাদি একটা কাঁসার থালার একদিকে তিনটে পিঠে আর তার পাশে একটা ছোট বাটিতে নতুন খেজুরের গুড় ঢালত। তারপর একহাতে খানপোশ চাপা দেওয়া সেই থালা আর অন্য হাতে হ্যারিকেন নিয়ে দাদি ফিরত ঘরে। ঘুমচোখে উঠে বসে বাপির অন্য বায়না শুরু হত। রোদে পিঠ দিয়ে বসে পিঠে খাবেন জনাব। গল্পের এই জায়গায় এসে আমি একটু অবাক হই। রাতদুপুরে ছেলের এহেন অন্যায় আবদারে পিঠে গুমগুম করে দুটো কিল না দিয়ে দাদি আবার টুকটুকু করে গিয়ে ঢুকত রান্নাঘরে। দেওয়ালে ঝোলানো চাল ধোওয়ার ধুচুনি আর চুলোর পাশে রাখা নেভানো লম্ফ নিয়ে আবার ঘরে।
তারপর দাদি সেই লম্ফ জ্বালিয়ে তার ওপর ধুচুনি চাপা দিত। ধুচুনির ফুটোগুলো থেকে বেরিয়ে আসা আলো বাপির কেন রোদ মনে হত জানি না। কিন্তু সেই ধুচুনির দিকে পিঠ করে বসে বাপি নির্বিবাদে চিতাও পিঠে খেত খেজুরের গুড় দিয়ে। আর দাদি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিত।
গল্পের শেষে দাদি চোখের কোণ থেকে জলের ফোঁটা মুছে নিত। সুখস্মৃতির অশ্রু।
আমি বাপির মত বায়নাদার ছিলাম না ঠিকই। কিন্তু কখনও বাগনান থেকে গ্রামের বাড়ি গেলে দাদি তার পোষা মুরগির থেকে একটা বেছে নিয়ে, মসজিদের মৌলবী সাহেবকে ডেকে পাঠিয়ে সেটা জবাই করিয়ে, সেই রাতদুপুরে আমায় রান্না করে খাইয়ে তবে শান্তি। রাতে দাদির পাশে শুয়ে শুনতাম কবে কোন শেয়ালটা এসে জানিয়ে গেছে এবার গাছে নারকেল ভালো হবে। অথবা কোন হাঁসটা সন্ধেবেলা খুল্লায় ঢোকার সময় বলেছিল আমি দাদির কাছে আজ আসব। দাদির গল্পের ভাঁড়ার অফুরন্ত।
একবার গ্রামে সাইকেল চোরের উৎপাত বেড়েছিল খুব। কারোর নতুন সাইকেল কেনা হলেই অবধারিত চুরি হত। আমাদের বাড়িতেও তখন ছোটকাকুর নতুন সাইকেল।
অনেক রাতে খুটখাট একটা শব্দে দাদির ঘুম ভেঙে গেল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে দাদি বোঝার চেষ্টা করল শব্দটা আসছে কোথা থেকে? একটা ধাতব টুং-টাং আওয়াজ আসছে বেলগাছের দিক থেকে। দাদি প্রায় নিঃশব্দে দরজা খুলে নামল মাটির বারান্দায়। সামনেই বেলগাছ, তার সরু গুঁড়িটার সাথে চেন দিয়ে বাঁধা ছোটকাকুর সাইকেল। সেই সাইকেলের সামনে ঝুঁকে পড়ে একটা লোক কী যেন করছে। চাঁদের আলোয় দাদি দেখল লোকটার দিব্যি ছায়া পড়ছে। জ্বিন-পরী কিছু নয়, একটা রোগাপাতলা দুবলা চোর। তখন হ্যারিকেনের পাট না উঠলেও দাদির হাতে দু ব্যাটারির টর্চ। দাদি সেটা জ্বালিয়ে লোকটার মুখে ফেলে কোমল স্বরে জিজ্ঞাসা করল – “কে বাবা তুমি?” লোকটা হকচকিয়ে মুখে হাত আড়াল করল টর্চের আলো থেকে বাঁচতে। দাদি আর একটু এগিয়ে যায় তার দিকে – “এত রাতে হেথায় কী করতেছ?” সাইকেল চোরের জীবনে এ অভিজ্ঞতা প্রথম। কেউ আক্রমণ করছে না, কেউ চ্যাঁচাচ্ছে না। এক বয়স্কা ভদ্রমহিলা শান্ত স্বরে জানতে চাইছেন সে কী করছে। কিন্তু আপ্যায়ন যতই মধুর হোক, চোরকে তো কেউ পা ধোওয়ার জল এগিয়ে দেবে না। তাই সে একছুটে পাঁচিল বেয়ে পালানোর চেষ্টা করল। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে বলে শোনা যায়। কিন্তু চোর পালাতে গিয়ে যে তার বুদ্ধিভ্রংশ হয়, এটা কেউ বলে না। পাঁচিলে না উঠে দরজা খুলে পালালেই পারত। কিন্তু পাঁচিল বাইতে গিয়ে বেশ খানিকটা পলেস্তারা আর পাঁচিলের ওপর দিকের আলগা ইঁট নিয়ে সে দমাস করে পড়ল। তারপর কোনওরকমে দাঁড়াতে গিয়েই আবার কোমর ধরে বসে পড়ল।
দাদি ততক্ষণে তার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। টর্চটা তার মুখে ফেলে দেখল কালিঝুলিমাখা খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা লোকটা যন্ত্রণায় কাঁদছে। দাদি তার পাশে বসে জিজ্ঞাসা করল – “কী হয়েছে বাবা?” লোকটা এবার হু-হু কেঁদে ফেলে – “খিদে পেয়েছে মা।” দাদির মমতা উথলে ওঠে। কতদিন তার কাছে কেউ খাবার জন্যে আবদার করেনি।
কুয়োতলায় নিয়ে গিয়ে চোরটাকে ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে নিতে বলে দাদি গিয়ে ঢুকল রান্নাঘরে। কতদিন মাঝরাতে চিতাও পিঠে হয়নি এ বাড়িতে। চালের গুঁড়ো মজুত আছে মাটির হাঁড়িতে। দাদি বসল পিঠে বানাতে।
চোরটা খেজুরের গুড় দিয়ে চিতাও পিঠে খেতে খেতে লাজুক মুখে জিজ্ঞাসা করে – “মা, বাসি ভাত আছে?” তার নিজের জন্যে নয়। বাড়িতে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে আছে তার। প্রায় দিনই তারা না খেয়ে ঘুমোয়। তা ভাত-তরকারি ছিল বইকি। সকালে কাজ করতে এসে আঙ্গুরাদি আর তার মা পান্তা ভাত আর গতরাতের তরকারি দিয়ে জলখাবার সারে। দাদি সেগুলো ব্যবস্থা করে চোরটাকে বেঁধে দিল।
এই পুরোটা সময় ছোটকাকু আর ছোটমণি নিজেদের ঘরে নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছিল। তাই বাড়িতে কী দারুণ একটা ব্যাপার ঘটে গেল, তা তারা জানতেও পারল না।
আমি কৌতূহলী হই – “দাদি, সেই থালাবাটি চোরটা আর ফেরত দিয়েছিল?” দাদি ফোকলা দাঁতে অপরূপ হাসে – “গরিব মানুষ। লাচার।”
সে বছর কুরবানির সময় গরু ছাড়ানোর সময় দেখা গেল একজন নতুন লোক কাজে লেগেছে। বাড়ির কেউ তাকে চেনে না। বাপি দু-একটা প্রশ্ন করে বুঝল লোকটাকে দাদি আসতে বলেছে। দাদিকে জিজ্ঞাসা করতে সে কাঁচুমাচু মুখে উত্তর দিল – “ও তো কাজিপাড়ার মতিয়ার গো। খেতে পায়নি, চুরিচামারি করে। তাই বল্লুন আসতে।”
প্রথমটা সবাই আঁতকে উঠেছিল। জেনেশুনে বাড়িতে চোর ঢোকানো? কিন্তু ক্রমে দেখা গেল, বাড়ির আশেপাশের জঞ্জাল পরিষ্কার বা সবে বরাতের আগে বাড়ির ঝুল-টুল ঝাড়া বা কোনও বিয়ে বাড়িতে ফাই ফরমাশ খাটা – আমাদের বাড়ির সব কাজেই প্রায় মতিকাকু জুড়ে গেছে। দাদির বিশ্বস্ত ডান হাত।
অবশ্য মতিকাকু তার চুরির অভ্যাস একেবারে ছাড়তে পারেনি। কোথাও পড়ে থাকা খুচরো টাকাপয়সা বা নতুন সাবান পারলেই সে লুঙ্গিতে গিঁট বেঁধে নিত। আর অধিকাংশ সময়ই ছোটকাকুর হাতে ধরা পড়ে বোকার মত আকর্ণ হাসত।
যেহেতু সে দাদির লোক, তাই সবাই দাদির কাছেই অভিযোগ নিয়ে যেত। আর আমার দাদি ফোকলা দাঁতে অপরূপ হাসত – “গরিব মানুষ। লাচার।”
[রসাতল, বইমেলা ২০১৫-য় প্রকাশিত]
0
March 29, 2015
Odbhut, gaay kanta dewa golpo. Tomar golpo bolar nesha tumi hoyto dadir thekei peyecho.
March 29, 2015
অমৃতরূপা, একেবারেই ঠিক ধরেছ। দাদির থেকে পেয়েছি গল্প বলার কিছুটা আর মায়ের থেকে পেয়েছি ডিটেলিং-এর কিছুটা। এই দুই মহিলা গল্প লিখলে আমরা বেশ কিছু ভালো গল্প পেতাম।
March 29, 2015
Rohon, opurbo golpo ebong awshdharon golpo bawla. Dadi-r golpo aaro onek onek shunte chai.
March 29, 2015
থ্যাংক্স তেজোময়দা। চেষ্টা করব লিখতে। এখন বাপির গল্প লিখছি। 🙂
April 14, 2015
আহা! প্রাণ জুড়োলো
April 14, 2015
শুভেচ্ছা রইল। 🙂
April 14, 2015
Awesome
April 14, 2015
Thank you 🙂
April 14, 2015
Erokom aro onek darun darun golpo Porte chai rohon.odur bhobissote rohon er Nam hok golpodadu.ei ashirbad kori.
April 14, 2015
দাদু আমি কোনওদিনই হচ্ছি না। 😀 থ্যাংক্স রে।
April 14, 2015
এগুলো দাদীর বলা গল্পের মতই…আর চিতই পিঠা বস্তুটি ত দাদীদের সঙ্গেই হারিয়ে গেছে…।
June 7, 2015
ঠিকই দিদি। এখন চিতাও পিঠে খাওয়ার অবসরই বা কই আমাদের?
April 15, 2015
Just superb! Rohan tomar Dadire selaam emon manush ajker duniyay Boro birol …tomar lekha ar notun kore ki bhalo bolbo
June 7, 2015
নীনাদি, দাদিকেই এখন মিস করি বড়ো বেশি। এমন মানুষ আর কোথায় পাব এখন? :'(
April 15, 2015
আমার বাংলার সব মায়েরাই এর’ম।
June 7, 2015
একদমই তাই।
August 8, 2015
এটা আমাকে ভাব প্রবণ করে দিল।
August 9, 2015
বুঝতে পারছি কৌশিকদা।