নিমোর সবে জন্ম হয়েছে। প্রথম দিনটা কাটিয়ে দ্বিতীয় দিনে পড়েছে সে। হঠাৎ দেখা গেল তার শরীর গরম, বডি টেম্পারেচার বেশ বেশি। ডাক্তার জানালেন, ব্লাডটেস্ট প্রয়োজন, কোনও ইনফেকশান হয়েছে কিনা জানতে হবে। সেদিন কোনও ছুটির কারণে সেই নার্সিংহোমের প্যাথলজি ডিপার্টমেন্ট বন্ধ। ৩-৪ স্টপেজ পরেই ভারতবিখ্যাত এক হাসপাতাল। সেখানে ব্লাড স্যাম্পেল নিয়ে যেতে হবে। এই ডাক্তার বলে দেবেন যাতে তাঁরা দ্রুত টেস্ট রেজাল্ট দিয়ে দেন। আমায় অনুরোধ করলেন, ছুটির কারণে তাঁদের স্টাফের সংখ্যা কম সেদিন। আমি যদি নিজেই কাজটা করে নিই। আমার আপত্তির কোনও কারণ ছিল না। ফলে একটা ছোট টিউবে রক্ত নিয়ে, সেটাকে বরফের প্যাকেটে মুড়ে রওনা দিলাম।
পৌঁছে জানা গেল, আমার আনা স্যাম্পেল টেস্ট করানোর আগে রেজিস্ট্রেশান দরকার। আমি ডাক্তারের লিখে দেওয়া কাগজটা বাড়িয়ে ধরলাম। কাউন্টারে বসে থাকা এক অল্পবয়স্ক তরুণ সেই কাগজ থেকে তাঁর কম্পিউটারে তথ্য ভরতে শুরু করলেন।
নাম — সান অফ নাফিসা বেগম।
বয়স — থার্টি সিক্স আওয়ার্স।
আমার থেকে জন্মতারিখও জেনে নিলেন তিনি। কয়েকটা তথ্য পরে এল — ধর্ম। আমি বললাম, “নট অ্যাপ্লিকেবল লিখুন।” তরুণটি মাথা নাড়লেন — “সেটা হবে না।” অর্থাৎ একটা ধর্ম বলতেই হবে। আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম — “একটা শিশু, যার এখনও নিজের কোনও নামই নেই, মায়ের নামে তার নাম লেখা হচ্ছে। তার বয়স এখনও ঘণ্টা দিয়ে মাপা হচ্ছে, তার জন্যে ধর্ম দেগে দেওয়াটা কী জন্যে দরকার?” সেই তরুণ অনড়। জানা গেল তাঁর ফর্মে রিলিজিয়ান একটা ম্যানডেটরি ড্রপডাউন ফিল্ড। সেটা ভর্তি করতেই হবে এবং ১৫-১৬টা অপশান থেকে একটা বেছে নিতেই হবে। আমি বিরক্তমুখে বললাম, “এখানে ইন-চার্জ কে? আমি কথা বলতে চাই।” তরুণ ইন্টারকমে কারও সঙ্গে কথা বলে জানালেন, সেই ব্যক্তি ঘণ্টা দেড়েকের আগে কথা বলতে পারবেন না। তারপর নিজে থেকেই বলল, “ততক্ষণে আপনার আনা ব্লাড স্যাম্পেল হয়তো নষ্ট হয়ে যাবে।” নিজের টেস্ট হলে দূর ছাই বলে সেই স্যাম্পেল সেখানেই ছুঁড়ে দিয়ে আসতাম। কিন্তু সন্তানের রক্ত তো, অনেক মমতায় তাকে আমরা এই পৃথিবীতে এনেছি। আমার মুখ দেখে সেই তরুণ রিসেপশনিস্টের হয়তো একটু মায়া হল। সমাধানের জন্য বললেন — “মায়ের নামেই যখন নাম লেখা হচ্ছে, তখন মায়ের ধর্মই রাখছি।” পরে কাজ মিটিয়ে ‘হাসপাতালে ভর্তির সময় কোনও রোগীর ধর্ম কেন জানাতেই হবে’ এই মর্মে একটা কমপ্লেন রেজিস্টার করে আসি।
সপ্তাখানেক বাদে একটা ফোন পাই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমার নালিশের ভিত্তিতে ‘একজন রোগীর ধর্ম জানাটা কেন জরুরি’ সেটা বোঝাতে ফোন করেছেন। ভদ্রলোক জানালেন, পেশেন্টের ধর্ম জানলে তাঁকে আরও ‘সেনসিটিভলি ডিল’ করা যায়। যেমন, হতেই পারে কোনও পেশেন্ট পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে চাইছেন। তাহলে তেমন ব্যবস্থা আমরা করে দিতে পারি। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, সেটা একটা অপশানাল তথ্য হতে পারে, ম্যানডেটরি হবে কেন? আমি ইসলাম ধর্মালম্বী বলেই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে পাঁচবার প্রার্থনা করতে চাইব, এমনটা ভাবা হাস্যকর। আমার বহু হিন্দু নামধারী বন্ধুদেরও চিনি, যাঁরা সকাল-সন্ধে আহ্নিক করেন না। যাঁদের এসব দরকার, তাঁরা জানাতেই পারেন। কিন্তু একজন মানুষের আবশ্যিক পরিচয় তাঁর ধর্ম কখনোই নয়। হয়তো এই বোধটা আমার নিজের ক্ষেত্রে আসত না, জিজ্ঞাসা করলে নির্দ্বিধায় ‘ইসলাম’ বলতাম। কিন্তু একজন শিশু, যাকে আমরা মাত্র কয়েকঘণ্টা আগে পৃথিবীতে স্বাগত জানিয়েছি, তার জন্যে ধর্মের পরিচয় কতটা গুরুত্বপূর্ণ? ভদ্রলোক আরও কিছু উদাহরণ দিতে চাইলেন। আগে জেনেছিলাম, তাঁর সারনেম চৌধুরী। কথা হচ্ছিল ইংরাজিতে। জিজ্ঞাসা করলাম, “মিস্টার চৌধুরী, আপনি বাঙালি?” জানা গেল উনি দিল্লির, গত দশ বছর আছেন ব্যাঙ্গালোরে। আমি বললাম, “আপনার সময় আর নষ্ট করতে চাই না। শুধু একটা কথাই বলব, আপনাদের রিসেপশান এরিয়ায় নারায়ণের মূর্তিটি (অনন্তশয্যার একটি নয়নাভিরাম মূর্তি আছে সেখানে) একটা বড় কাপড় দিয়ে ঢেকে দিন প্লিজ।” তিনি একটু রেগেই গেলেন। বুঝিয়ে বললাম — “একজন বাঙালি কবি প্রশ্ন করে গেছেন, বিশ্বপিতা নারায়ণের যদি নিজের জাতপাত ধর্ম নিয়ে চিন্তা না থেকে থাকে, তাহলে তাঁর সন্তানদের সেসব নিয়ে এত মাথাব্যথা কেন? আপনাদের নিয়মনীতি দেখে নারায়ণ প্রতিদিনই কষ্ট পান নিশ্চিত। তাঁকে রেহাই দিন।” ভদ্রলোক আমায় কবিতা আউড়ানেবালা কল্পরাজ্যে বসবাসকারী একজন নির্বোধ প্রতিপন্ন করে দারুণ বিরক্তিতে ফোন রেখে দিয়েছিলেন।
সেই থেকে প্রতিদিন প্রার্থনা করে চলি — হে মাওলা, আমি সাধারণ মানুষ। আমার জীবনচর্যা, আমার ধর্মাচরণ আমার সন্তানের ওপর বর্তাবে ঠিকই। আমি সমাজ-সংসার অস্বীকার করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী নই। কিন্তু হে পরওয়ার দিগর, আমার সন্তান যেন মুসলমান হওয়ার আগে একজন মানুষ হয়ে উঠতে পারে।
আফটার অল, মানুষকে ‘আসরাফুল মাখলুকাত’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, আমার সন্তান যেন সেই বিশেষণের যোগ্য হয়ে উঠতে পারে।
ওমনিস্কোপ
Homepage of Rohon Kuddus
August 1, 2017
এটা বড্ড বেশিরকম ভালো!