কয়েকমাস আগের একটা অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেল। আবু ধাবি থেকে কলকাতাগামী ফ্লাইটে আমার পাশে বসেছিলেন আরেক বাঙালি। বয়স মেরেকেটে একুশ-বাইশ হবে। আমিই আলাপ জমালাম। আবু ধাবিতে কবে থেকে আছেন, কী করেন ইত্যাদি। জানা গেল তিনি বাংলাদেশের মানুষ, কুমিল্লায় বাড়ি। কলকাতায় মামা আছেন একজন। তাঁদের কাছে যাচ্ছেন দুর্গাপুজোর কলকাতা দেখতে। মাসদেড়েক থাকবেন। বাড়ি যাবেন না? উত্তরে জানালেন, এ যাত্রায় আর সেটা সম্ভব নয়। বাড়ি গেলেই বাড়তি খরচ।
সব ঠিকঠাক চলছিল। গোল বাধল কলকাতায় নেমে। তরুণ সহযাত্রীটি যেহেতু ভারতীয় নন, তাই তাঁকে ইমিগ্রেশান ফর্ম ভর্তি করতে হল। বোঝাই যাচ্ছিল ইংরাজিতে সড়গড় নন। জন্মতারিখের জায়গায় পাসপোর্ট নাম্বার লিখে ফেলছেন, আমিই তাই আগ বাড়িয়ে ফর্মটা ভর্তি করতে শুরু করলাম। স্থানীয় ঠিকানা কী লেখা হবে? তিনি মামার ঠিকানা জানেন না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, মামা কোথায় থাকেন? তিনি জানালেন, কাছেই। আমি লিখে দিলাম ‘দমদম’। ইমিগ্রেশানের বেড়া টপকে আমি গিয়ে দাঁড়ালাম একচিলতে বারান্দায়। পেছনে সেই তরুণের ওপর রীতিমত চোটপাট চলছে সম্পূর্ণ ঠিকানা না থাকায়। কথাবার্তাগুলো কানে আসছিল। এক সময় তিনি আমার দিকে দেখিয়ে নিচু গলায় কিছু বললেন, ইমিগ্রেশান অফিসার আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমি কী করি, কোথা থেকে আসছি, কীভাবে এই তরুণকে চিনি ইত্যাদি। জানালাম। উনি ফিরে যাচ্ছেন, আমি অনুরোধ করলাম, “স্যর, ছেলেটির মামাকে একবার ফোন করে ঠিকানাটা জেনে নিলে হয় না?” ভদ্রলোক সরু চোখে জরিপ করছেন দেখে বললাম, “ছেলেটির কাছে নিশ্চয় নাম্বার আছে। সত্যি বলতে কী, ওই দমদমটা আমারই লেখা। তাই…” এবার একটু গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার এত দরদ কেন বলুন তো? কে হয় আপনার?” কাঁচুমাচু মুখে বললাম, “সত্যি বলতে কী স্যর, বাংলাদেশের মানুষের প্রবাদপ্রতিম অতিথিপরায়ণতার কথা শুনেছি। যাইনি কোনওদিন সেখানে, কিন্তু সেই দেশের একজন বিপাকে পড়েছেন দেখে এখানে একা ছেড়ে যেতে মন সায় দিচ্ছে না।” ভদ্রলোক এমন উত্তর আশা করেননি দেখা গেল। আমায় আবার বেড়ার এদিকে আসতে না দিলেও ওই তরুণের থেকে নাম্বার এনে দিলেন। মামাকে ফোন করে ঠিকানা জেনে আবার একটা ফর্ম ভর্তি করে দিলাম। ওদিকে আমায় নিতে এসেছেন যাঁরা, তাঁরা ঘনঘন কল করছেন। ছেলেটির মামা তাঁকে এয়ারপোর্টে নিতে আসছেন, এমন নিশ্চয়তা পেয়ে বাইরের দিকে পা বাড়াচ্ছি। সেই অফিসার পিছু ডেকে বললেন, “ভাই, আপনি তো খবরে নিশ্চয় দেখেন বাংলাদেশ থেকে কী হারে অনুপ্রবেশ ঘটে আর তার ফলে এখানে কী ঘটে। আমাদের এইসব নিয়ম নিয়ে একটু কড়াকড়ি করতেই হয়। অতিথিদের সমস্যায় ফেলতে আমরাও চাই না। কিন্তু আপনার মতোই আরও পাঁচজন মানুষের নিরাপত্তার দায়ও আমাদের ওপর বর্তায়।” এমন কথার ওপর কথা হয় না। ঘটাঘট মাথা নেড়ে বিদায় নিলাম।
পরে ফোন পেয়েছিলাম, মামা-ভাগ্নে রওনা দিয়েছেন এয়ারপোর্ট ছেড়ে। মামার গলায় কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ছিল — “আপনি থাকাতে* কী উপকার যে হল।”
*যদি ভেবে থাকেন বাংলাদেশে আমাদের (মানে সৃষ্টিসুখের) বই পাঠানোর কথাবার্তা চলছে আর সেজন্যে আমার মসিহামার্কা ইমেজ প্রচারের চেষ্টা করছি, তাহলে ভুল** ভাবছেন।
**ওয়েল, ফিফটি পারসেন্ট ভুল ভাবছেন। বাকি ফিফটি পারসেন্ট যদি বাংলাদেশে কখনও যেতে পারি, তার আগাম আটঘাট কষে বাঁধার জন্যে।
4
Leave a Reply