ঘটনাটা ঘটেছে আগের শুক্কুরবার। বইমেলা যাওয়ার পথে। বনগাঁ লোকালে চড়ে শিয়ালদার দিকে যাচ্ছি। হৃদয়পুরে এক ভদ্রলোক উঠলেন গলায়-কাঁধে নানাবিধ যন্ত্র নিয়ে। একটা সাউন্ড বক্স, তার ব্যাটারি আর একটা যেন কী, হাতে একটা মাইক্রোফোন। জানা গেল, গান-টান গেয়ে লোকজনের মনোরঞ্জন করেন, তার বদলে পয়সা চেয়ে থাকেন। যাই হোক, এমন আয়োজন দেখে বেশ উৎসাহ নিয়ে কান খাড়া করলাম। শুরু হল, ‘রাজার পঙ্খী উইড়া গেলে…’ শ্যামল মিত্রের গলায় গানটা শোনার সময় ‘দুখী শূন্য খাঁচায় কান্দে রে’ — শূন্য উচ্চারণের সময় যে হাহাকার তৈরি হয়, সেটা প্রতিবার মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করি। কিন্তু এই গায়কের ক্ষেত্রে শূন্যর সেই শূন্যতা দূর-অস্ত, প্রথম দু’লাইন শুনে খুব ইচ্ছে হল লোকটাকে ধরে দরজা দিয়ে বাইরে উড়িয়ে দিই। আমার গলায় গান আর বেঙ্কটেশ প্রসাদের হাতে ব্যাট একই ব্যাপার। কিন্তু ধর্মেন্দ্রও যদি আমার গলা টিপে ধরেন, এই গানটা ওই ভদ্রলোক যেভাবে গাইছিলেন, আমি তার থেকে নিশ্চিত ভালো গাইতে পারব।
দাঁতে দাঁত চেপে গানটা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। গান শেষ হওয়ার পরে ভদ্রলোক এদিক-সেদিক থেকে পয়সা সংগ্রহ করছিলেন। আমার কাছে আসার পরে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে বললাম — “আপনাকে এই পঞ্চাশ টাকা দিতে পারি। কিন্তু এই গানটা আর কখনও গাওয়া চলবে না।” ভদ্রলোক ভাবলেন আমি মজা করছি। তারপর আরও আধমিনিট ধরে ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করার পরে তিনি দরাদরিতে নামলেন। শেষমেশ ঠিক হল, গানটা প্রকাশ্যে না গাওয়ার জন্যে পঁচাত্তর টাকা দিতে হবে (আমার কাছে ওইটুকু খুচরোই ছিল)। তবে কেউ যদি এই গানটা গাইতে ওঁকে অনুরোধ করেন, তাহলে কিন্তু উনি গানটা গাইতে পারবেন। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তেমন ভিড়ও ছিল না। তবু পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক সহযাত্রী কান পেতে আমাদের কথোপকথন শুনছিলেন। নিউ ব্যারাকপুরে আমাদের এই গায়ক নেমে যাওয়ার পরে তিনি সশ্লেষে বললেন, “আপনি পাগল! ও তো পরের কামরায় উঠে আবার ওই গান গাইবে।” আমি তেরিয়া গলায় বললাম, “লোকটাক বাঁচানোর চেষ্টা করেছি, বুঝলেন? উনি পয়সা নিয়েও কথা না রাখলে একদিন মজা টের পাবেন।” আমার বলার ভঙ্গীতে ভদ্রলোক সামান্য গুটিয়ে গেলেন দেখে সামান্য অপ্রস্তুত হলাম। সাফাই দেওয়ার মতো করে বললাম, “ওই গান শুনে কেউ না কেউ ওনাকে ট্রেন থেকে ফেলেই দেবেন।” নিজের মনের কথা বাইরে বেরিয়ে পড়ছে দেখে সামান্য লাগাম দিলাম — “বা ধরুন কেউ দু’ঘা ধরিয়ে দিল।” ভদ্রলোক মুচকি হেসে বাইরের দিকে তাকালেন।
দমদম জংশনে নেমে ভিড় ঠেলে এগোচ্ছি। সামনের একটা কামরা থেকে আওয়াজ ভেসে আসছে সেই গায়কের গলা — ‘সেই কান্না কেউ শোনে না, চেনা মানুষ হয় অচেনা…’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে প্রবোধ দিলাম, নিশ্চয় কেউ অনুরোধ করেছে লোকটাকে ওই গান গাইতে। তাই সে প্রাণপণে বেসুরো গলায় গাইছে —
‘…নীতি, ধম্ম, ভালোবাসা
সবই যেন খেলার পাশা
ও তার জীবন যেন বন্দী হইল
জুয়া খেলার ফান্দে…’
February 11, 2017
গাইতে থাক। গাইতে গাইতেই গায়েন।
February 11, 2017
বেশ। আপনার আশা দেখে আমিও বুক বাঁধলাম।