নিমোর জন্ম

আমি দারুণ নিশ্চিত ছিলাম আমাদের প্রথম সন্তান মেয়ে হবে। এতটাই নিশ্চিন্ত ছিলাম যে, নামের লিস্টে ছেলেদের ভাগে কোনও নামই রাখিনি আমি। আর মেয়েদের ভাগে একটাই নাম ছিল – অথৈ। (আশা করা যাক, আমাদের দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ [যদি লিপি এর মধ্যে একটার জন্যেও রাজি থাকে] প্রচেষ্টায় একজন কন্যাসন্তান জন্ম নেবে এবং তখন আমরা নামটা ব্যবহার করতে পারব।)

অষ্টম মাসে ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরে লিপি একদিন ভয় দেখাল, “যদি ছেলে হয়? তখন কী নাম রাখবে ভেবেছ?” খুব সত্যি বলতে কী, এরপর কয়েক মিনিট আমি সত্যিই মন দিয়ে ভেবেছিলাম এবং নিমো নামটা ছাড়া আর কিছুই মনে আসেনি। অথৈ নামটা লিপির পছন্দের ছিল (অন্তত মুখে তাই বলত), কিন্তু নিমো নামটা তার বোধ হয় ঠিক মনঃপূত হল না। কিন্তু অত সহজে হাল ছাড়ার পাত্তর তো আমি নই। তাই সাম্প্রতিকতম আলট্রাসোনোগ্রাফির রিপোর্টটা নিয়ে আমি নিমোর একটা রাফ স্কেচ করতে বসে গেলাম। লিপিকে দেখালাম – “এ ছেলের নাম নিমো ছাড়া আর কী হতে পারে বলে তোমার মনে হয়?” লিপি একটু ভেবে বলল – “ব্যাটম্যান?!” আমি কয়েক সেকেন্ড ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে ঘাড় নাড়লাম – “ভালো নাম ব্যাটম্যান রাখা যেতেই পারে।” কথোপকথনের এই বিন্দুতে লিপি দুমদাম পা ঠুকে বেডরুমে ঢুকে গেল।

ব্যাটম্যান নিমো

এই পোস্ট আমাদের দাম্পত্যের খুঁটিনাটি নিয়ে নয়, কিন্তু যেটা উল্লেখ না করলেই নয় – লিপির গুণেই ঐ সময়টা আমাদের দাম্পত্যের সবথেকে সুখের ছিল (এখনও পর্যন্ত)। মানছি, মাঝে মাঝে তার পা টিপে দিতে হত। বা রাতে ভয় পেয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়লে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে হত। কিন্তু সেগুলো কোনও বাড়তি কাজ বলে মনেই হত না। কারণ, আমায় সহ্য করার জন্যে সেই সময় লিপি কোনও রহস্যজনক উপায়ে একটা প্রোমো প্যাক এ্যাক্টিভেট করিয়েছিল। অবশ্য মাঝে মাঝে সেই প্রোমোও কাজ করত না। এই যেমন ব্যাটম্যানের ব্যাপারটা। কিন্তু এর জন্যে লিপিকে একতরফা দোষ দেওয়াটা ঠিক নয়। ব্যাটম্যানের বাবা-মাও সমান দোষী। তাঁরা ছেলের নাম ব্রুস ওয়েন না রেখে ব্যাটম্যান রাখলে আমার কাজটা সহজ হত।

 

যাই হোক, এর দিনকয় পরে একটা ব্লাড টেস্টের রিপোর্টে লিপির লিভারের কোনও একটা এনজাইম মাত্রায় বেশি পাওয়া গেল। ডাক্তার বললেন, সেটা সামান্য চিন্তার। কী রকম? ইলেকট্রনিক সিটির ছোটো একটা নার্সিংহোমের যে ডাক্তারকে আমরা দেখাতাম, তিনি সৌভাগ্যক্রমে বাঙালি। তাই সহজেই সুবিধা-অসুবিধার কথা বুঝিয়ে বলা যেত। যদিও বহুদিন বাংলার বাইরে থাকার কারণে তাঁর কথ্য বাংলা আমার বাংলা হাতের লেখার মতোই হয়ে গেছে এখন; পীড়াদায়ক।

তা তিনি আমাদের বোঝাতে আরম্ভ করলেন।

“রক্তে এই এনজাইম বেশি হলে, বেবি ভিতরেই মোশান পাস করে। আর তারপর এই মোশানটাই আবার লিকুইডের সঙ্গে খেয়ে নেয়।” খেয়ে নেয় কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটা ঢোঁক গিলে বোঝানোর চেষ্টা করলেন কীভাবে খেয়ে নেয়। নিজের অজান্তেই আমার জিভের স্বাদ ইয়াক-টাইপ হয়ে গেল।

“কাল ভর্তি হয়ে যাবেন। বেবি এখন ম্যাচিওরড। আমরা কাল বের করে নিব।” ভদ্রমহিলা বের করাটাও যথারীতি দুহাত দিয়ে টেনে আনার মুদ্রায় দেখালেন। বেচারা লিপির দিকে তাকিয়ে দেখি তার মুখ শুকিয়ে গেছে। তাই হাতের ওপর আলতো চাপ দিলাম – “চিন্তা কোরো না। আজ না হলে কাল তো ভর্তি হতেই হত।” ডাক্তারও আমায় সমর্থন করে ভরসা জোগাতে চেষ্টা করলেন – “সেটাই। সব মাকেই একদিন না একদিন ওখানে যেতেই হয়।” ইশারায় তিনি ওপরে হাত তুললেন।

তিনতলায় ওঁদের ম্যাটারনিটি ওয়ার্ড।

 

সেদিনটা ছিল অক্টোবরের ন তারিখ। আমার বাপি-মা আর লিপির মা ব্যাঙ্গালোরে উড়ে আসছেন। তাঁরা তখনও জানেনই না ডাক্তার কী বলেছেন। আমরা ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরোনোর পর ফোন এল তিন মূর্তি ব্যাঙ্গালোরের মাটিতে পা রেখেছেন। যাই হোক, এয়ারপোর্ট ক্যাবে চড়ে ঘণ্টা আড়াই পরে তাঁরা হাজির হলেন আমাদের ইলেকট্রনিক সিটির ফ্ল্যাটে। তখন রাত প্রায় নটা। সবাইকে বসিয়ে জল-টল খাইয়ে ধাতস্থ করে আমি কথাটা পাড়লাম।

লেডিজ এ্যান্ড জেন্টলম্যান, উই আর হ্যাভিং এ বেবি টুমরো।

খবরটা শুনে জনগণ প্রথমে মুষড়ে পড়ল।

“সে কী! একদিনও রেস্ট পাব না?”

“এখনও তো তিন সপ্তা বাকি ছিল?”

“আর কোনও ডাক্তার দেখালে হয় না? টাকার লোভে এরা জলদি পেট কাটতে চায়।”

আমি হিটলারি চালে এসব কথায় জল ঢেলে দিলাম – “তোমাদের নাতি বা নাতনি লিপির পেটের ভেতর বসে বসে নিজের পটি খাচ্ছে। ভেবে দ্যাখো, তিন সপ্তা পরে যখন সে বের হবে, সেই মুখে চুমু খাবে কী করে।”

 

এমন ভোঁতা আঘাতের ওপর কথা হয় না। অতএব পরেরদিন আমরা গিয়ে হাজির হলাম সেই নার্সিংহোমে। ছোটো আয়োজন তাদের, কিন্তু লিপির জন্যে একটা আলাদা কেবিন পাওয়া গেল। ডাক্তার দেখে গেলেন। বেশ কিছু ইঞ্জেকশান আর স্যালাইন চালু হয়ে গেল। মাঝে মাঝেই নার্সরা এসে হাসিমুখে আমায় ঘর থেকে খেদিয়ে দিয়ে কীসব করতে লাগলেন। জানা গেল, ডাক্তার মহোদয়া চাইছেন নর্মাল প্রসিডিওরে বাচ্চাকে ভূমিষ্ঠ করাতে। কিন্তু যার জন্যে এতকিছু, এত স্যালাইন, এত ইঞ্জেকশান – সেই প্রসব বেদনার দেখা কই? সারা সকাল গড়িয়ে, দুপুর পেরিয়ে, বিকেল হয়ে গেল। আমার ম্যানেজার এর মধ্যে দুবার ফোন করল – “কুচ হুয়া!” আমি একটু বিরক্ত হই – “আরে ইয়ার, বাত আগার কোডিং কি হোতি তো ডিবাগ করকে চালা লেতা আব তক।” ওদিক থেকে সেও সায় দেয় – “বোতো হ্যায়।” বসের গলায় চিন্তা শুনে স্বভাবসিদ্ধ গলায় আবার আশ্বস্ত করি – “লেকিন আপ টেনশান না লিজিয়ে। কুচ ভি হো যায়ে, ডেলিভারি আজ পাক্কি হো রাহা হ্যায়।” গত কয়েক বছরে আমার মুখে এই লব্জ শুনে শুনে সে অভ্যস্ত। তাই অন্যান্য বারের মতো সেও নিশ্চিন্তে ফোন নামিয়ে রাখে – “ইয়ার তু হ্যায় তো চিন্তা নেহি হ্যায় মুঝে। আজ তক এক ভি ডেলিভারি ডিলে হুয়া হ্যায় তেরি? বাস সামভাল লেনা। অওর হো জানেকে বাদ এক ফোন কর দিও।”

সফোদের ক্লায়েন্টকে ডেলিভারেবেলস্‌ পাঠানোর নাম ডেলিভারি কে দিয়েছিল কে জানে।

 

সন্ধেবেলা ডাক্তার এসে ষড়যন্ত্রসঙ্কুল গলায় জানালেন – “এবার ওটিতে নিয়ে যেতে হবে।” অর্থাৎ এতক্ষণ ভালোয় ভালোয় বলেছি। কথা যখন শোনোনি, তখন ঘাড় ধাক্কা দিতেই হবে। লিপি আমাদের সবার দিকে একবার করুণ চোখে তাকিয়ে অপরেশান থিয়েটারের দিকে রওনা দিল।

সময় আর কাটে না। টেনশান কাটাতে আমি একবার সিঁড়ি বেয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে জল খেতে গেলাম। হঠাৎ ওপর থেকে শোনা গেল ‘ওঁ-য়া-য়া! ওঁ-য়া-য়া!’ এক-একবারে তিন-চারটে সিঁড়ি টপকে আমি নিমেষে তিনতলায়। ততক্ষণে নার্স বাইরে এসে আমার নাম ধরে ডাকাডাকি করছেন। আমি গুটিগুটি তাঁর পিছু নিলাম। কান্নার আওয়াজে কান পাতা দায় তখন। আমার মনের মধ্যে চলছে – ‘টিক-টক! টিক-টক!’ অর্থাৎ অথৈ না নিমো। নিমো না অথৈ। একটা ছোটো প্লাস্টিকের খাঁচায় শুইয়ে রাখা আছে একরত্তি একটা বাচ্চাকে। সে তখনও তার আফটার বার্থ অভিজ্ঞতায় ধাতস্থ নয়, কেঁদেকেটে সেটাই জানান দিয়ে চলেছে। একজন চাইল্ড স্পেশালিস্ট তাকে সেই খুপচি বাক্স থেকে বের করে একটা কাপড়ে জড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে এলেন – “ইয়োর সান।”

নিমো!

তাকে দু হাতে ধরে এক মুহূর্তের জন্যে মনে হল এ পৃথিবীতে কোনও রাগ-বিদ্বেষ-অভিযোগ নেই। সফো হিসাবে আমি কয়েক লাখ লাইন কোডিং করেছি। কিন্তু এর থেকে বাগ-ফ্রি একজিকিউশান হতেই পারে না। কবিতা বা গল্প লিখিয়ে হিসাবে হাবিজাবি অনেক কিছু লিখেছি। বন্ধুত্বের খাতিরে কেউ কেউ সেগুলোর প্রশংসাও করেছেন। কিন্তু আমার হাতের মধ্যে যে জীবন্ত মানুষটা খলবল করছে, আমার কোনও কবিতা বা গল্পই কখনও তার মতো এত সুন্দর হতে পারবে না। এ আমার মাস্টারপিস।

আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, অথৈ নামটা এত প্রিয় ছিল আমার। কিন্তু সেই মুহূর্তে (এবং এখনও) নিমোর থেকে আর প্রিয়তম কোনও নাম হতেই পারে না মনে হল। কয়েক মুহূর্ত পরে তাকে ডাক্তারের হাতে ফেরত দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম – “আমার স্ত্রী?” জানা গেল, তার অপারেশান তখনও চলছে।

বেরিয়ে এলাম আস্তে আস্তে। আমায় তখন ঘিরে ধরেছে বাপি এবং মায়েরা। নাতি হয়েছে। বাপি এক এক করে বাড়ির সবাইকে ফোন করতে আরম্ভ করল। দুই মায়ের হাতে আরও তিনটে ফোন। আর আমি? মনে হচ্ছিল ছাদে উঠে গিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সবাইকে বলি। কিন্তু সারাদিনের পর আর সে শক্তি অবশিষ্ট নেই। ফেসবুকের জন্যে আপডেট আগে থেকে তৈরি করা ছিল। অথৈ নামটা পালটে পোস্ট করে দিলাম। (পরে নিমো যখন এই জায়গাটা পড়বে, তখন জানি তার কেমন রাগ হবে। হে! হে! হে! কিন্তু নিমো, আমি তোর নামটা তখন ঠিকঠাক লিখেছিলাম, সেই অজুহাতে বুড়ো বাপকে ক্ষমা করে দিস। তখন অথৈ লিখলে পরে কী কেলো হত ভেবে দ্যাখ।) তারপর তো সারা পৃথিবী জেনে গেল নিমো হয়েছে। কতজন যে ফোন করলেন তার ইয়ত্তা নেই।

 

এরই মধ্যে এক নার্স কাপড়ে মুড়ে-টুড়ে প্যাকেট করে নিমোকে আমাদের হাতে দিয়ে গেলেন। আমি তো থ। “ওরে! আমরা যে বাইরের জামাকাপড় পরে আছি, তার কী হবে? বুঝলাম নার্সিংহোমটা ছোটো তোদের! তা বলে হাইজিনের এটুকু নিয়মনীতি তো মেনে চল।” উচ্চারণ করে বলিনি অবশ্য। মাথার মধ্যে একটা করাতের ধারওয়ালা ডায়ালগ বেলুনে তেড়েফুঁড়ে ক্যাপ্টেন হ্যাডক চেল্লাচ্ছিল। নিমোকে নিয়ে আমরা ঢুকলাম কেবিনে। লিপি তখনও ওটি-তে যদিও। আমরা বড়ো বেডের পাশের এক চিলতে ডিভানে নিমোকে কোলে নিয়ে বসলাম।

আমার মা ততক্ষণে তার ফোন থেকে খুঁজে বের করেছে আজানের একটা এ্যাপ। সদ্যোজাতকে আজান শোনানো মঙ্গলকর ব্যাপার। আমি সামান্য খুঁতখুঁত করি – “বাচ্চাদের কানে এইসব ফুসমন্তর কী না দিলেই নয়? লাদেনের কানেও আজান দেওয়া হয়েছিল ছোটোবেলায়… যা মঙ্গল হয়েছিল…” আমার শাশুড়ি মাতা স্কুলে পড়াতেন। তাই মাকে বাঁচাতে তিনিই এগিয়ে এলেন – “লাদেনের কানে আজান দেওয়া হয়েছিল কী করে জানলে? হয়তো দেওয়া হয়নি বলেই সে লাদেন হয়েছিল।”

কিন্তু এইসব কুচুটে যুক্তির ধার কে ধারে তখন? যাকে নিয়ে এতসব কাণ্ড, সেই নিমো চকচক শব্দে আঙুল চুষছে। আমি ভিডিও তুলে রাখছি। মা সেই আওয়াজ ফোনে রাঙাকাকুকে শোনাচ্ছে। মোবাইলের রেডিয়েশান, আমাদের জীবাণুভর্তি জামাকাপড়, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ – সব মিলিয়ে বাইরের কেউ সেই কেবিনে এসে দাঁড়ালে আঁতকে উঠতেন। নিমোর জন্যে তার চারজন সবচে কাছের মানুষ তখন নরক গুলজারে ব্যস্ত।

এরপর লিপিকে এক সময় ওটি থেকে নিয়ে এলেন দুজন নার্স। তার তন্দ্রাও কাটল এক সময়। সে নিমোকে দেখে বলল – “এঁ এ্যাঁ এঁ ওঁ…” আমার শাশুড়িমাতা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রাত তখন দশটা। আগেই জানা ছিল, বাড়ির একজনকে লিপি এবং নিমোর সঙ্গে রাতে থাকতে দেওয়া হবে। সেদিন রাতে কে থাকবে, সেই নিয়ে উপস্থিত জনগণ গণতান্ত্রিক উপায়ে আলোচনা করতে গেলেন। কিন্তু আমি হিটলারি কায়দায় তাড়া লাগালাম – “আমার ছেলে। আমার বউ। আমি থাকব।” লিপির বড়ো বেড। নিমোর ছোট্ট কট। আমার এক চিলতে ডিভান।

অনেক রাতে লিপি তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন। আমি ল্যাপটপ ব্যাগ থেকে প্রিয় তিনটে বই বের করলাম। ঘরে একটা মৃদু আলো জ্বলছে। সেই আলোয় নিমোর কানের কাছে বাংলা কবিতা-গদ্য পড়ে শোনাতে লাগলাম। একে একে পিগিকলোনি, তৃতীয় বিশ্বের ইতিহাস আর পিজ্জা বালক থেকে এক পাতা করে পড়ে শোনালাম। আরবি আজানে বাঙালির ছেলের যদি মঙ্গল হয়, তাহলে বাংলা সাহিত্যে মঙ্গল না হয়ে যায় কোথায়। কিন্তু নিমোর বোধ হয় আধুনিক বাংলা সাহিত্য ঠিক ধাতে সইল না। পিজ্জা বালকের পড়া শেষে করেছি কি করিনি, তারস্বরে চিৎকার শুরু করল। বাইরে থেকে একজন আয়া ছুটে এলেন। নিমোকে কোলে তুলে নিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে শান্ত করতে করতে আমার দিকে তাকালেন। আমার হাতে তখনও বই তিনটে ধরা আছে, বামালসমেত ধরা পড়ে গেছি। তাই নীরব তিরস্কারের দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে নিমোকে তার জায়গায় শুইয়ে লাইট অফ করে দিয়ে চলে গেলেন।

বাইরে থেকে চাঁদের বিষণ্ণ আলো ঝাঁপিয়ে ঢুকে পড়ল জানালা দিয়ে। কিছুদূরের ফ্লাইওভার দাপিয়ে চলে যাওয়া দৈত্যাকার ট্রাকগুলোর আওয়াজ বাতানুকূল ঘরের মধ্যে ঢুকছে না। শুধু এয়ার কন্ডিশনারের একটা ঝিম ধরানো মৃদু আওয়াজ। নিমোর কটের দিকে একটু ঝুঁকে দেখতে চেষ্টা করলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে সে ব্যাটা দেখি প্যাট প্যাট করে তাকিয়ে আছে আমার দিকেই। আমি চোখ বন্ধ করে মৃদুস্বরে শুরু করলাম – “আয় রে ভোলা খেয়াল খোলা/ স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়…” এ কবিতা বই না খুলেই অনায়াসে শোনানো যায়। কিন্তু দু লাইনের পরেই সন্ত্রস্ত হয়ে চোখ খুললাম, যদি আবার ‘ট্যাঁ’ শুরু হয়! কিন্তু চুপ করতেই সে মৃদুস্বরে বলে কিনা – “ল্যা।” আমার সঙ্গে নিমোর প্রথম বাক্যালাপ।

আমি আবার শুরু করলাম।

“আয় রে পাগল আবোল তাবোল

মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়।

আয় যেখানে খ্যাপার গানে

নাইকো মানে নাইকো সুর।”

তার পরের লাইনগুলো বলতে গিয়ে গলা কেঁপে গেল। কোত্থেকে চোখ ঝাঁপিয়ে দরদর বন্যা এল।

“আয় রে যেথায় উধাও হাওয়ায়

মন ভেসে যায় কোন সুদূর…”

 

চোখ খুলে দেখি আমি আর নিমো ছাড়া এ চরাচরে আর কিছু নেই, কেউ নেই তখন। চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া সেই নার্সিংহোমের ঘর, দূরের ফ্লাইওভার, হুশহাশ ছুটে যাওয়া ট্রাক সবকিছুর ওপর দিয়ে দুজন নির্ভার নির্ভয় উড়ে চলেছি। আর আমার সন্তান আমার দিকে তাকিয়ে বলছে – “ল্যা।”

30
68 Comments
  • Sanhita
    April 12, 2015

    wah! wah!

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 12, 2015

      Thanks Sanhita. 🙂

  • Nina
    April 12, 2015

    eto sundar Baba Chheler goppo ami age kokhono pori Ni
    Anonde amaro chokhe jol
    May all dreams come true for this father & son

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 12, 2015

      Means a lot to me NinaDi. 🙂

  • Arun Kumar Mallik
    April 12, 2015

    অসাধারণ লেখাটি . মুগ্ধ হলাম।

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 12, 2015

      নিমোর জন্যে প্রার্থনা কোরো অরুণ, ও যেন বড়ো হয়ে ওঠে।

  • Subrata Ruj
    April 12, 2015

    WOW!!!!!

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 12, 2015

      Thanks SubrataDa. 🙂

  • rumki ray dutta
    April 12, 2015

    Osadharon oviggatar bornona…..onek onubhuti….k …nijer sathe onubhob korte parlam.

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 12, 2015

      আমরা সব বাবা-মা-ই এই অনুভূতিগুলোতে তো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকি। 🙂

  • Dhiman
    April 12, 2015

    Khub Bhalo. Porte Porte Ekebare Onyo Jogote chole gechilam 🙂 Mugdhota

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 12, 2015

      আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম।

  • অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
    April 12, 2015

    অনন্যসাধারণ

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 12, 2015

      শুভেচ্ছা জানবেন। 🙂

  • Pranab Basu Ray
    April 12, 2015

    ভারি মনোরম, সুখপাঠ্য লেখা কমই পড়েছি। প্রতি মুহূর্ত মূর্ত হয়েছে, জীবন্ত হয়েছে…যেন চলচিত্র। আমার নাতনির জন্ম সময়ের কথা মন্র পড়ে যাচ্ছিল। তার জন্মানোর খবরে আমি আর আমার স্ত্রী নাকি এত জোরে উল্লাস প্রকাশ করেছিলাম ঐ নার্সিংহোমের কেউ নাকি কখনও শোনে নি। নিমোর আগামী জীবন যেন সুস্থ, আনন্দময়, পরিপূর্ণ হয়–এই শুভ কামনা জানিয়ে রাখলাম। তুমি ও লিপি ভালো থেকো।

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 12, 2015

      আপনার আশীর্বাদ অক্ষয় হোক নিমোর জন্যে। 🙂

  • Aditi Sarkar
    April 12, 2015

    আরবি আজান, আবোলতাবোল, শেক্সপিয়র, রবীন্দ্রনাথ সবকিছু নিয়ে সবকিছু ছাপিয়ে বাবার স্নেহে এমনি মাখামাখি হয়েই থাকুক নিমো, বড় হোক, মানুষ হোক।

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 12, 2015

      থ্যাংকু অদিতিদি। 🙂

  • samsuddin
    April 12, 2015

    osadharon….dada….best wishes fr ur son

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 12, 2015

      Thank you Samsuddin. 🙂

  • SK FARIDUL RAHAMAN
    April 12, 2015

    নিমো খুব ভালো থেকো ।

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 12, 2015

      নিমো শুনে বলল — “ল্যা।” মানে, তুমিও ভালো থেকো।

  • কনিষ্ক ভট্টাচার্য
    April 12, 2015

    নম ছ মাস হওয়ার পরে পড়া হল লেখাটা … বড়ো হয়ে পড়িস নিমো …

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 12, 2015

      আমারও একই প্রার্থনা। যেন পড়ে। যেন পড়ে। 🙂

  • arthit
    April 12, 2015

    Speechless ! Ah !

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 12, 2015

      🙂

  • snhehashis
    April 12, 2015

    darun upabhog korlam.

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 12, 2015

      জেনে খুশি হয়েছি খুব।

  • Sushmita
    April 12, 2015

    sapon dola duluk….baba’r kalom chaluk…

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 12, 2015

      তোমার মুখে চপ-কাটলেট পড়ুক দিদি। 😀

  • Aparna Bhakat
    April 12, 2015

    asadharon anuvuti…tomar moto baba peye Nemo sarajibon nijeke lucky feel korbe.. 🙂 anek bhalobasa

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 12, 2015

      Lucky Me. 🙂

  • cinthia nazneen
    April 12, 2015

    Darun ebong osadharon.eitai mone hochche rohon er best sahityo kirti.

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 12, 2015

      ‘Masterpiece’ to be precise 😉

  • Tarique aziz mondal
    April 12, 2015

    Ato sundor Bornona diyecho dada j ami puro tai jno choker samne dekhlam akn e…darun describe korecho darun obhiggotar…

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 12, 2015

      তার মানে তুমি একটা গাইডলাইন পেয়েই গেলে। 🙂 ওয়েলকাম। 😀

  • cinthia nazneen
    April 12, 2015

    Nemo boro hoye ei lekha jokhon porbe bujhte parbe tar baba take koto bhalobase.khub sundor hok baba cheler ei somporko.nemo o onek boro hok.

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 12, 2015

      নিমো এই লেখা পড়ার আগেই তার বাপের ভালোবাসা ‘টের’ পাবে। আমি নিশ্চিত। 😀

  • soumita
    April 12, 2015

    Khub bhalo laglo rohon da….

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 12, 2015

      Thank you Soumita. 🙂

  • সৃজন
    April 12, 2015

    ক্যায়া বাত !!

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 12, 2015

      🙂

  • ঋজু গাঙ্গুলি
    April 12, 2015

    চোখে জল এনে দিলেন যে ব্রাদার! আমার শুভেচ্ছা আর আশীর্বাদ রইল নিমোর জন্যে। বড় হোক, ভালো থাকুক।

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 12, 2015

      ই-কোলাকুলি।

  • Shakuntala
    April 12, 2015

    Nemo aye re tobe bhuler bhobe oshombhob er chhonde te. Ki shundor likhechish Rohon. Ek bochorer jonmodine ektu Deshe
    Bideshe pore shonash. Khoob bhalo tui
    Lipi Nemo 🙂

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 13, 2015

      Thank you ShakuntalaDi.

  • saon banerjee
    April 13, 2015

    Bhisan,bhisan bhalo lekha ,monta sakalbela pore bhalo hoye gelo,khub sundar lekhen apni,apnar lekhar recent boi ta porechhe r bhalo legechhe khub,aro likhun ,agam nobobarser shubhechha roilo.

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 13, 2015

      আপনাকেও নববর্ষের আগাম শুভেচ্ছা শাওন।

  • washim parvez
    April 13, 2015

    allaha nimo ka valo rakhuk,islamick halot a cholar toufik dan koruk …..

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 13, 2015

      মানুষ যেন হয় সেই প্রার্থনাটা কোরো। 🙂

  • Swikriti
    April 13, 2015

    masterpiece indeed dada Nemo anek boro hobe 🙂

    • rohonkuddus@gmail.com
      April 13, 2015

      তোমাদের শুভেচ্ছা থাকলে সে বড়ো হবে তো বটেই।

  • দেবাশীষ দাশগুপ্ত
    April 15, 2015

    নিমো বড় মানুষ হোক, কিন্তু নিমোর বাবা যেন বুড়ো না হয় — এটাই প্রার্থনা।।

    • rohonkuddus@gmail.com
      June 7, 2015

      নিমোর বাবা থোড়াই বুড়ো হয়। 😀

  • Mirza Anir
    April 29, 2015

    Darun laglo… Really ak onno jogot a chole giechilam…Sob kichu jeno nijer choke dekte pacchilam…

    Nemo obossoi akta khub valo manus hoye uthbe… After all Masterpiece ar chele to Masterpiece hobei…
    Lots of love Nemo!!!

    • rohonkuddus@gmail.com
      June 7, 2015

      থ্যাংক ইউ ভাই। তোমার মতো কাকারা থাকতে নিমোর মানুষ হওয়া নিয়ে আমার চিন্তা নেই বিশেষ। 🙂

  • Sk Md Obaidullah
    June 25, 2015

    apnar ei lekha ti pore ‘saadat’ er hobar dintar proti ta muhurto mone vese utchilo…..Allah apnder khub valo rakhun…..apnar Nimo onek boro hok…

    • rohonkuddus@gmail.com
      June 26, 2015

      সাদাতও অনেক বড় হোক। মানুষ হোক। 🙂

  • Tanmay
    September 8, 2015

    Tomar lekha pore khub sundor laglo Dada..tomar ro ro lekha khujbo,,khujenebo..valo theko..r emon lekha ro ro ro lekha..

    • rohonkuddus@gmail.com
      September 8, 2015

      Thanks 🙂

  • Suparna Bhaumik
    December 5, 2015

    এত সুন্দর লেখা যে পড়ার পর কমেন্ট না করে থাকতে পারলাম না। আমিও যেন দেখতে পাচ্ছি নিমোকে, ছুঁয়ে নিতে পারছি পিতা হয়ে ওঠা একজন মানুষের পরিপূর্ণতার অনুভূতিগুলো। খুব ভালো লাগল ।

    • rohonkuddus@gmail.com
      December 11, 2015

      শুভেচ্ছা জানবেন। 🙂

  • Himadri Sekhar Datta
    June 25, 2016

    এ লেখাটা আমি আগে পড়ি নি। হয়তো চোখ এড়িয়ে গেছে। অসাধারণ লেখা। আমি জানি নিমো খুব বড় হবে একদিন। কোন এক ছবি দেখে আমি বোধহয় তোমায় সে কথা বলেছিলাম। আমরা সকলেই জীবনে এই স্টেজটা পাই, সাধ্যমতো আনন্দ বিতরণ করি সকলের মাঝে নতুন জীবন কে নিয়ে। এ লেখা তারই মর্ম কথা। আমি আবার বাবা হলাম যেন।গড ব্লেস।

    • rohonkuddus@gmail.com
      June 25, 2016

      থ্যাংকিউ হিমাদ্রীদা। 🙂 এই আশীর্বাদটুকু থেকে নিমো যেন বঞ্চিত না হয়।

  • ABU TALHA PURKAIT
    June 25, 2016

    জীবনের প্রথম বাবা হয়ে ওঠার কোনো মুহূর্তই ‘লিপি’-বদ্ধ করতে তুমি বাদ রাখনি …….এ এক অদ্ভুত ভালোলাগা …. পড়েই যেন অনুভব করে ফেললাম ….নিমোর জন্য দুআ রইলো …

    • rohonkuddus@gmail.com
      June 25, 2016

      শুভেচ্ছা রইল তোমার জন্যে। 🙂

  • নীলোৎপল সিংহরায়
    July 24, 2016

    হয়তো এভাবে লেখাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, তবুও, আপনার লেখাটা পড়ে মনে হল, কোনোদিন যদি আমার নিজের সন্তান হওয়ার সৌভাগ্য হয়, (মানে তার আগে যদি কোনো মেয়ের নিজের সব্বনাশ করার ইচ্ছে হয় আমাকে বিয়ে করে) তবে এই ঘটনার সাথে সাদৃশ্য থাকবেই, বিশেষ করে ‘ব্যাটম্যান’। ওই লাইনটা পড়ে মনে হল বলি ‘দাদা, আপনি তো আমার দলের লোক’। যাই হোক, অনেকদিন পরে পড়লাম লেখাটা, কিন্তু বেটার লেট দ্যান নেভার। অসংখ্য ধন্যবাদ এরকম একটা লেখার জন্য; মনটা ভরে গেল…

    • rohonkuddus@gmail.com
      July 24, 2016

      এই তো আমার দলভারী হচ্ছে। 🙂

      শুভেচ্ছা জানবেন।

Leave a Reply to সৃজন Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *