মৃত্যুর পরে দেহ থেকে ফুসফুস, পাকস্থলী, যকৃত এবং অন্ত্র আলাদা পাত্রে ভরে রাখা হত। মৃত্যুর পরে আত্মা যখন আবার দেহের কাছে ফিরে আসবে, তখন পাত্রগুলো থেকে ওই দেহাংশ তার কাজে লাগবে পুনর্জাগরণের পরে। আর হৃদযন্ত্র? না, হৃদযন্ত্র বা হৃদয় থাকবে মৃতদেহের মধ্যেই। কারণ পরলোকে মানুষটার ঠাঁই স্বর্গে হবে কিনা, তার বিচার হবে ওই হৃদয় দিয়েই। বিচারকক্ষে প্রবেশ করে মানুষটা ৪৩ জন দেব-দেবীকে বোঝানোর চেষ্টা করবে সে জীবিত থাকার সময় পাপকর্ম তো দূর, কারোর সঙ্গে চেঁচিয়ে কথা পর্যন্ত বলেনি। একে এক সব কিসিমের এই নেগেটিভ টেস্টিং-এ লোকটা যদি পাস করে, তবে তার হৃদয়টা চাপানো হবে একটা বড় দাঁড়িপাল্লায়। তার একদিকে বসবেন সত্য আর ন্যায়বিচারের দেবী মাত আর অন্যদিকে বসানো হবে মানুষটার হৃদয়। মানুষটাকে দশটা প্রশ্ন করা হবে। মুখে সে যা-ই বলুক না কেন, হৃদয় সত্যি কথা বলবেই। শেয়ালমুখো দেবতা আনুবিস লক্ষ রাখেন দাঁড়িপাল্লা কোনদিকে হেলছে। আর পুরো ঘটনা লিপিবদ্ধ করার ভার থাকে জ্ঞানের দেবতা থটের হাতে। সবকটা প্রশ্নের শেষে যদি দেখা যায়, দাঁড়িপাল্লা স্থিরসাম্যে আছে, মানুষটা তার হৃদয় ফেরত পাবে আর পাবে দৈবী সিলমোহর – এ হৃদয় তার দেহ থেকে আর বের হবে না। এরপরই মিলবে ফাইনাল এগজামে বসার অনুমতি। অর্থাৎ পরলোকের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ওজাইরাসের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ। যেহেতু তার হৃদয় নিয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই, তাই মানুষটাকে নিজের কথা বলতে দেওয়া হবে। আর সেই ভিত্তিতে ওজাইরাস ঠিক করবেন লোকটা স্বর্গে যাবে, নাকি নরকে।
যদি হৃদয়ের পাল্লা ভারী হয়ে নীচের দিকে ঝুঁকে যায়, তাহলে বিচারসভায় উপস্থিত আমিত (কুমিরের মাথা, সিংহের দেহ আর সামনের পা এবং জলহস্তীর পেছনের পা দিয়ে বানানো এক হাঁসজারু) কপ করে গিলে ফেলবে সেই হৃদযন্ত্র। আর মানুষটার অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। পুফ! ডেটাবেস থেকে পুরো রেকর্ড ডিলিট — সে কোনওদিন ছিলই না। মাত-কে একটা পালকের সঙ্গে তুলনা করা হয়। তাই প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করত জ্ঞান, বুদ্ধি আর বিবেক দিয়ে সৎ কাজ করে হৃদয়কে রাখতে হবে পালকের মতো হালকা। তবেই স্বর্গলাভের পথে এগোনো সম্ভব। এ সবই নাকি বুক অফ ডেড-এ লেখা আছে।
কায়রো মিউজিয়ামের প্যাপিরাস ঘর থেকে এই ছবিটা তোলা। ওপরে মৃত মানুষটি দেব-দেবীদের তার পাপকর্ম না করার কথা বোঝাচ্ছে। নীচে দেখানো হয়েছে, তার হৃদয় ওজন করার গল্পটি। দু হাত ওপরে তুলে যে ভঙ্গি, সেটা কা অর্থাৎ মানুষটির প্রাণস্পন্দন। তার পাশে হাত নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে মানুষটির নশ্বর দেহ। দাঁড়িপাল্লার ফ্রেমে দাঁড়িয়ে আছেন শেয়ালমুখো আনুবিস, যিনি ওজন দেখছেন। আর তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে বাজপাখির মাথাওয়ালা হোরাস। হৃদয় ওজনের পরীক্ষায় উতরোলে ইনি মানুষটিকে নিয়ে গিয়ে হাজির করবেন ওজাইরাসের সামনে। থটকে দেখা যাচ্ছে খাতা-পেন নিয়ে লেখালেখি করতে। তাঁর সামনে বসে আছে হৃদয়খেকো আমিত। আর সবার সামনে বসে আছেন ওজাইরাস, যিনি একাধারে জীবন, মৃত্যু, পরলোক আর পুনর্জন্মের দেবতা।
1
Leave a Reply