গত বুধবার দমদমে বসে আছি, ব্যাঙ্গালোরের প্লেনে উঠব-উঠব করছি। আমার দিকে এক ভদ্রলোক হাসিমুখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন — “আপনি রোহণ কুদ্দুস?” আঈ বাপ! আমায় দেখে আজকাল লোকজন এয়ারপোর্টেও চিনতে পারছেন? জামা ফুঁড়ে ছাতি বেরিয়ে আসার জোগাড়। যাই হোক, বাক্য বিনিময় শুরু হল। উনি জানালেন, বইমেলার স্টলেও আমায় দেখেছেন। কিন্তু ভিড় দেখে (ওহ! আর একটা ছাতি চওড়া করা ব্যাপার। সৃষ্টিসুখ-এর স্টলে বেজায় ভিড় হয়েছিল এবার। হুঁ! হুঁ!) আর কাছে এসে কথা বলতে পারেননি। আমি দেঁতো হেসে বললাম — “ভিড় তো কী। আমি তো আপনাদের সঙ্গে কথা বলব বলেই এবার গিয়েছিলুম বইমেলায়। যাক গে, কথা তখন হয়নি বটে, এখন হোক।”
ওমা! দু-চার কথা বলেছি কী বলিনি, পাশ থেকে কে যেন ডাকল — “রোহণদা।” বাপরে! একজনের বেশি লোক আমায় এয়ারপোর্টে চিনে ফেলেছে। কিন্তু ঘুরে দেখি, অলোকপর্ণা। ওহ! অলোকপর্ণা। সে তো ঘরের লোক। সে চিনেছে তো আর বেশি কথা কী। কিন্তু ভেতরে সেই যে একজন বসে থাকে না? যে কিনা লক্ষ রাখে ট্যাক্সিতে ৯৫ টাকা খরচ করে অফিসে এসে ১৯৫ চাইছি কিনা, বা সিটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বয়স্ককে জায়গা ছেড়ে দিয়ে উঠছি কিনা (এটা পড়লে আবার অনেকেই রে-রে করে উঠবেন, বয়স্ক বলেই জায়গা ছাড়তে হবে? ইল্লি আর কী!); সে ভেতর থেকে ডেকে বলল — “ওরে চামার! এই অলোকপর্ণাই তোদের কলকাতার যত ঝক্কি সব সামলাত। কাঁধে করে প্রেসে থেকে বই আনা, সে সব কলেজ স্ট্রিটে পৌঁছে দেওয়া, রাত জেগে তোদের লেখা কম্পোজ করে দেওয়া… একটু তো ভক্তি শ্রদ্ধা দেখা।” ভেতর থেকে যখন আওয়াজ আসে (সে চেতনার হোক, বা জৈবিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার), তখন লুকোনোর জায়গা পাওয়া মুশকিল। তাই আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোককে বললাম — “এ হল অলোকপর্ণা। আমার বোনই বলা চলে।” অলোকপর্ণা একগাল হেসে বলল — “ওখানে বাবা বসে।” অলোকপর্ণার বাবা নিপাট ভদ্রজন, অতনুর বইপ্রকাশের সময় বাড়ি গিয়ে আলাপ হয়েছিল। তাই ওনার সঙ্গেও দেখা করতেই হয়। উনি জানালেন, দু মিনিট আগেই উনি আর অলোকপর্ণা আমায় নিয়ে আলাপ করছিলেন। আর হঠাৎ অলোকপর্ণা আমায় দেখিয়ে বলে, “ঐ তো রোহণদা দাঁড়িয়ে আছে।” মেসোমশায় আপ্লুত হয়ে বললেন, “এসব ঘটনা তুমি কীভাবে ব্যাখ্যা করবে!” ব্যাখ্যা অবশ্য খুবই সহজ। সফোদের তো প্রায়ই হয়। কিউবিকলে বসে বসের শ্রাদ্ধশ্রান্তি করছ, হঠাৎ বস এসে হাজির। সেই যে কার যেন নাম নিলেই সে হাজির হয়? যাই হোক, অলোকপর্ণা ব্যাঙ্গালোরে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছে। খবরটা আগেই পেয়েছিলাম, কিন্তু সেটা যে আমার ফ্লাইটেই (হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন, আমার বাবা গতমাসে ইন্ডিগোর এই প্লেনটা কিনেছেন।) তা জানতাম না। চমৎকৃত হলাম। যাই হোক, পুরো রাস্তাতে মাঝে মাঝে আমাদের দেখা-টেখা হল। ব্যাঙ্গালোরে পৌঁছে আমি ওনাদের রাস্তা বাতলে দিলাম আর কলকাতায় এয়ারপোর্টে আলাপ হওয়া ভদ্রলোকও ঐ রাস্তায় যাবেন জেনে ওনাদের একসাথে ভিড়িয়ে দিয়ে আমি subway-এর দিকে হাঁটা দিলাম। পেট চোঁ-চোঁ করছিল।
এত কথা বলা যে জন্যে, সেইটা খোলসা করি। অলোকপর্ণা শেষ পর্যন্ত চাকরিটা পেয়েছে — পৃথিবীর অন্যতম একটা সেরা সফটওয়ার কোম্পানিতে (না, আমাদেরটার মতো অত ভালো নয়। আমাদেরটা জগতসেরা। ওদেরটাও ভালো। তবে আমাদেরটা ভালোতর।); তবু তার একটুও গর্ব নেই। আধখানা ফেসবুক স্ট্যাটাসও দেয়নি সে। তাই ভাবলাম আমিই একটু ঢাক পেটাই। যতই হোক, অলোকপর্ণা এখন সফো। আর সত্যি বলতে কী, অচিরেই আমি বলতে শুরু করব, “অনেক সফোই আছে, যারা ভালো লেখে, তাদের মধ্যে একজন অলোকপর্ণা। তাকে আমার বোনই বলা চলে।”
Congrats অলোকপর্ণা!
3
Leave a Reply