মুজেয়ুম স্টেশানের সামনে দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে গান গাইছিল লোকটা। গলায় ঝোলানো গিটার। গানের সুরে সেটাও বাজছে। গানবাজনার কিছুই বুঝি না প্রায়। তাও আবার এই বিজাতীয় ভাষায়। তবু লোকটার গলায় কী যেন একটা আকুতি ছিল। দাঁড়িয়ে পড়লাম। ঘড়িতে প্রায় দশটা। লোক চলাচল কমে গেছে। পাল্লা দিয়ে কমে চলেছে তাপমাত্রাও। অফিস থেকে বেরোনোর সময় দেখেছি মাইনাস দুই। তার ওপর পা চালিয়ে সামনের ট্রাম স্টপে না পৌঁছলে পরের ট্রাম ঝাড়া আধ ঘণ্টা পরে। তবু দাঁড়িয়েই পড়লাম। পথচলতি কেউ কেউ দু-একটা কয়েন ছুঁড়ে দিচ্ছে। লোকটা সেদিকে না তাকিয়ে আপন মনে গেয়ে চলেছে। মিনিট কয়েক পরে গান শেষ করে সে পয়সা কুড়োতে উদ্যোগী হল। আমিও তার সাহায্যে হাত লাগালাম।
আমার থেকে কয়েনগুলো নিয়ে গুনতে গুনতে সে ভাঙা ইংরাজিত জিজ্ঞাসা করল — “তুমি গাও?” আমি দুদিক মাথা নাড়লাম। মৃদু হেসে সে বলল — “সবাই গান গায়। বোবা মানুষও। আর তুমি গাও না? বললেই হল!” আমি আবার দুদিকে মাথা নাড়ি। কিন্তু নাছোড়বান্দা সে — “শাওয়ার চালিয়েও নয়?” বাথরুম সিঙ্গারদের বোধ হয় দেশকাল ভেদ নেই, এই সত্যটা আবিষ্কার করে আমার মাথা নাড়াটা বোধ হয় এবার কিছুটা দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। সে গিটার বাগিয়ে ধরল — “তুমি গাও, আমি বাজাই।”
এ জীবনে দুটো গানই মাত্র পুরোপুরি জানি। রবিঠাকুরের ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ আর সুমনের ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু’। কী মনে করে দ্বিতীয়টাই শুরু করলাম। আমার গলার দমকে প্রথমে বোধ হয় লোকটা সামান্য চমকে গিয়েছিল। তারপর দেখলাম দু কলি শোনার পর সে দিব্যি বাজাচ্ছে আমার বেসুরো গানের সঙ্গে। বাংলা গান এ তল্লাটে কেউ কোনওদিন শোনেনি বোঝা গেল। তার ওপর গায়ক ভিনদেশী এক লোক। পিঠে অফিস ব্যাগ পরনে ধোপদুরস্ত শীতপোশাক। সঙ্গে একজন উড়নচণ্ডী গিটারবাদক। তার কাপড়চোপড়ে শীত মানে না, তবু গিটারের গায়ে ঝমঝম বাজছে আঙুল। জনা চার-পাঁচ দাঁড়িয়েই পড়ল। টুংটাং সিকিটা, টাকাটাও পড়তে থাকল। গান শেষ হওয়ার পর দেখা গেল পঁয়তাল্লিশ ক্রাউন জমা হয়েছে। আমার হাতে দুটো দশ ক্রাউনের কয়েন গুঁজে দিল গিটার ঝোলানো লোকটা। গান গেয়ে সে-ই আমার প্রথম ও শেষ উপার্জন — ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় পঞ্চাশ টাকা।
তিনি কবীর না চাটুজ্জে, তিনি তৃণমূলের না মুসলমানের সেসব প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। তবে প্রাগের সেই রাতে হিমাঙ্কের নিচে খোলা রাস্তায় তিনি কয়েকজন চেক আর একজন বাঙালির ছিলেন। বিশেষত এক ভবঘুরেকে রাতের খাবার জোগাড়ে তিনি প্রভূত সাহায্য করেছিলেন। গত সপ্তা দুয়েক তাঁর পীড়াদায়ক লেখা এবং তাঁর সম্পর্কে আরও অনেকের ধারালো মতামত পড়ে মনে হল এই লেখাটাও দেওয়ালে থাক। যদি তাঁর নজরে আসে।
2
Leave a Reply