শিবরাম চক্কোত্তির একটা গল্প ছিল না ‘একদা একটি কুকুরের পা ভাঙিয়াছিল’ বা এরকমই কিছু? গল্পটা শিব্রামবাবুর নাও হতে পারে, ঠিক মনে নেই। তবে ব্যাপারটা এরকম।
একবার এক কুকুরের পায়ের হাড় ভেঙেছিল। এক ডাক্তার দয়াপরবশ হয়ে তার পায়ে ব্যান্ডেজ করে দেন। পরদিন দেখা যায়, সেই নেড়ি তার আরও এক রাস্তাতুতো ভাইকে নিয়ে ডাক্তারবাবুর বাড়ির দরজায় এসে হাজির। তারও চিকিৎসার প্রয়োজন। তার পরদিন এসে হাজির মোট চারটে কুকুর। এভাবে এক থেকে দুই, দুই থেকে চার, আট, ষোলো — কুকুরের সংখ্যা দিনে দিনে দ্বিগুণ হতে থাকে। শেষে কুকুরের ঠ্যালায় ডাক্তারবাবুর প্রাণ ওষ্ঠাগত। যদ্দূর মনে পড়ে ডাক্তারবাবু কোনওভাবে সেই সারমেয়কুলকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করেন এবং ফলস্বরূপ তাদের কামড় খান।
আমার হালত এখন সেই মহাত্মা সাজতে যাওয়া ডাক্তারের মতোই। একবার টিভির পর্দায় আমির খানের অনুরোধে একটি বাচ্চাদের সেবার জন্যে নিয়োজিত সংস্থায় মিসড কল দিই (প্লিজ আমায় কেপ্পণ ভাববেন না, আমিরবাবু মিসড কল দিতেই বলেছিলেন)। যাই হোক, কদিনের মধ্যেই তাঁরা ঘুরিয়ে কল করেন। টিভিতে বলা হয়েছিল মাত্তর সামান্য কিছু টাকায় একটা বাচ্চার সারামাসের ভরণপোষণ চলে যাবে। কিন্তু তাঁরা বললেন, টাকার অঙ্কে আরও কিছুটা যোগ করলে ভালো হয়। বাকিটাতে একজন গর্ভবতী মায়ের সারা মাসের ওষুধপথ্যের ব্যবস্থা হবে। তখন সবে নিমো আসার একটা আভাস পাওয়া গেছে, তাই প্রাণে ধরে না করতে পারলাম না।
এর কদিন পরে আর একটা সংস্থা থেকে ফোন এল। তারা অন্ধ বাচ্চাদের সামলায়। যে শিশুরা এই পৃথিবীর কোনও দৃশ্যই চাক্ষুষ করতে পারে না, তাদের অন্তত জ্ঞানের আলো দেখাতে এই সংস্থা তৎপর। তাদেরও না করতে পারলাম না। আগের সংস্থার মতোই এরাও অঙ্গীকার করল, প্রতি তিন মাস অন্তর আমার স্পন্সর করা বাচ্চাটার রিপোর্ট কার্ড ইত্যাদি পাঠাতে থাকবে। আমি অনুরোধ করেছিলাম আমায় ডাকে না পাঠিয়ে সেগুলো ইমেল করতে। তাঁরাও আশ্বস্ত করেছিলেন। প্রতি মাসে নিয়ম করে আমার ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্ট থেকে আরও কিছু টাকা বিযুক্ত হতে থাকল। কিন্তু রিপোর্ট কার্ড তো দূরস্থান, টাকার রিসিপ্টও দু-তিনটের বেশি পাইনি আজ পর্যন্ত। সেগুলো দেখিয়ে আয়করে ছাড় নিতামই এমন কথা বুক বাজিয়ে বলতে পারি না। তবু কেউ তার নিজের কাজ ঠিকমতো করছে না দেখে রাগ হত। অনেকবার মনে করেছি, এবার স্ট্যান্ডিং ইন্সট্রাকশানগুলো বন্ধ করে দেব। কিন্তু যখনই নিমোর দিকে তাকাতাম, ভাবনা বদলাতে বাধ্য হতাম। আমার সন্তানকে সাধ্যমতো আরাম-আয়েসে বড় করছি। ওদিকে কিছু শিশুর কোনওমতে দু মুঠো খাবার বন্দোবস্ত হয়তো হচ্ছে আমার পাঠানো টাকাতেই।
এর মধ্যেই আমায় ফোন করেছে আরও দুটো সংস্থা — ক্যান্সার রোগীদের জন্যে একটি সেবাসদন এবং পোলিও আক্রান্ত শিশুদের দেখভাল করার একটা আবাসন। অতএব আরও দুটি ই সি এস তৈরি হল আমার এ্যাকাউন্টে। এরা তবু মাঝেমধ্যে রিসিপ্ট পাঠায়। মিলিয়ে না দেখলেও বোধ হয় ঠিকই পাঠায়। কিন্তু এদের টাকার দরকার খুব বেশিই বোধ হয়। মাসের মাঝেও টাকা চেয়ে ফোন করে মাঝে মাঝে। কখনওই দিইনি যদিও, দিতে পারিনি। কিন্তু কোথাও একটা বিরক্তি তৈরি হচ্ছিল ভেতরে ভেতরে। অথচ বিবেকের তাড়না বড় দায়। তাই এই চারটে জায়গাতে টাকা দেওয়াও বন্ধ করতে পারছিলাম না।
গত দেড় বছরে প্রচুর ফোন পেয়েছি। শুধু ব্যাঙ্গালোরেই মানুষের সেবার জন্যে এত সংস্থা যে, অনায়াসে এই শহরকে সিটি অফ এঞ্জেলস বলা যায়। যাই হোক, এদের সবাইকেই আমি জানাই ইতিমধ্যেই চারটে সংস্থাকে আমি মাসান্তে সাহায্য করে থাকি। আমার দ্বারা আর সম্ভব নয়। তবু ফোনের ওপর ফোন চলতে থাকে। তাদের থামাতে এককালীন সামান্য কিছু টাকা দিয়েছি। কিন্তু সব মিলিয়ে বিরক্তি বাড়ছিল। প্রত্যেক প্রোমোশানের সঙ্গে ভ্যারিয়েবল পে বেড়ে টেক হোম স্যালারি কমছে, আর ভেতর থেকে শিব্রামের সেই ডাক্তারবাবু ভদ্দরলোকের দানছত্তর বাড়ছে। একদিন না একদিন কিছু একটা হওয়ারই ছিল। আজ সেটা হল।
বিকেলের দিকে লেখালেখির কাজ করছি, কলিং বেল বাজল। দরজা খুলতেই দেখি কাঁধে লাল ঝোলা ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণ। আমায় দেখে বিগলিত হেসে হাত বাড়াল — “হ্যালো স্যর।” হাত মিলিয়ে একটা ফাইল বের করল সে। ছবি দেখাতে শুরু করল। কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ আর তামিলনাড়ুতে তাদের ছাত্রাবাস। গরিব ছেলেমেয়েরা থাকে এবং মহিলারাও স্বাবলম্বী হওয়ার মতো ট্রেনিং পান। তাঁদের হাতে বানানো ধূপের প্যাকেট বের করল ঝোলা থেকে। আমি বিনীতভাবেই জানালাম, আমার পক্ষে এখন সাহায্য করা সম্ভব নয়। কিন্তু তাদের ঠিকানা রেখে গেলে আমি সরেজমিনে দেখে কিছু চিন্তা করতে পারি। ছেলেটি এমনভাবে হাসতে আরম্ভ করল, যেন খুব মজার একটা কথা বলেছি। তারপর আমায় বলল, “আপনি পাঁচ হাজার টাকা দেওয়ার জন্যে এতদূর বাসে-ট্রেনে যাবেন?” আমি বুঝলাম না এর মধ্যে পাঁচ হাজার এল কী করে। তবু আমি আবার আগের কথাগুলোই বললাম। শেষে যোগ করলাম, “আমি অবশ্যই যাব। যে ছাত্রাবাসটা কাছে হবে, সেটাতে যাব। ঠিকানা দাও।” এবার সে ব্যাঙ্গালোরের একটা ঠিকানা দিল। আমি আশ্চর্য হলাম। এ তো একেবারেই বাড়ির কাছে,
বাসে হয়তো মিনিট কুড়ি। তাহলে এর আগে এতদূর বাসে ট্রেনে যাওয়ার গল্প এল কী করে? এবার ছেলেটা বোঝাল, এটা তাদের হেড আপিস। আমি সেখানে গিয়ে খোঁজ নিয়ে টাকাপয়সা দিলেই হবে। আমি বেশ বিরক্ত হয়েই তাকে বললাম, “তুমি এসো ভাই। কাজের কাজ না করে একই কথা বলে চলেছ। আমার ঠিকানা দরকার ওই ছাত্রাবাসগুলোর। আমি নিজে চোখে দেখতে চাই।” সে আবার তার ফাইল মেলে ধরল। তাতে ছবি আছে কিছু ছেলে এবং কিছু মেয়ে একসঙ্গে খাচ্ছে, খেলছে, পড়াশোনা করছে। আমি মাথা নেড়ে ‘গুডবাই’ বলে দরজা বন্ধ করতে যাব, সে আমার দরজার পাল্লা ধরে চেঁচিয়ে এবার যা বলতে শুরু করল, তা এরকম।
আমার মতো লাখো-করোড়ো কামানেবালারা নিজেদেরটা ছাড়া কিছুই বুঝি না। এই বাচ্চাদের সাহায্য না করার ফল অচিরেই আমি টের পাব।
তার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে ল্যাপটপের কাছে ফিরে এসে বসে চিন্তা করতে শুরু করলাম এবং অচিরেই একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেল। আমাদের দেশে ধরেই নেওয়া হয়, সেবার নামে টাকা দেওয়াটা বাধ্যতামূলক। আমার টাকা থাকলেই আমায় সেটা প্রকাশ্যে বিলি করতেই হবে, নাহলে আমি খারাপ লোক। তাই প্রথম দুটো সংস্থা টাকার রিসিপ্ট বা বাচ্চাদের রিপোর্ট কার্ড পাঠানোর প্রয়োজন মনে করে না। পরের দুটো সংস্থা তাই তাদের সুবিধামতো যখন খুশি টাকা চেয়ে ফোন করে।
ব্যাঙ্কে ফোন করলাম। কাস্টমার কেয়ার থেকে জানাল, ই সি এস বন্ধ করতে ব্রাঞ্চে যাওয়া প্রয়োজন। কাল তাই করব। তবে তার আগে চারটে সংস্থাকেই ফোন করে জানাব, কেন আমি তাদের টাকা দেওয়া বন্ধ করছি। চারপাশে নজর করলেই বহু মানুষ দেখতে পাই, যাদের সাহায্যের দারুণ দরকার। হয়তো তারা হাত বাড়াতে সঙ্কোচ বোধ করে। তাই প্রতিমাসে ই সি এস-এ দান করার আত্মপ্রসাদে হাত না সেঁকে ভাবছি এবার থেকে রোজ কিছুটা সময় মাটিতে কান পেতে থাকব।
মানুষের ভালো করার চেষ্টা করলে উপায়ের অভাব হবে না আশা করা যায়।
ওমনিস্কোপ
Homepage of Rohon Kuddus
Leave a Reply