গতমাসে ভারতের এক নামী কোম্পানির ইন্টারনেট ডঙ্গল কিনেছিলাম। তারা বুক বাজিয়ে বলেছিল চোদ্দো এমবিপিএস স্পিড দেবে। ও হরি! ব্যবহার করতে গিয়ে দেখি একশ কেবিপিএস-ও আসে না। তাদের কাস্টমার কেয়ারে জানাতে বলল, “কোই না জি। আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে ঠিক করে দেব।” তা কত আটচল্লিশ ঘণ্টাই যে প্রতিদিন কাটতে লাগল, তার ইয়ত্তা নেই। প্রতি তিনদিন অন্তর ফোন করি আর তারা বলে ‘এই যে হচ্ছে’, ‘এই যে হবে’। শেষে তিতিবিরক্ত হয়ে বললাম, “নিকুচি করেছে তোমাদের আটচল্লিশ ঘণ্টার, দাও কানেকশান কেটে। আমি অন্য কোম্পানি দেখি।” তারা বলে, “সে কী! এর মধ্যে ধৈর্য হারালে বাপ? ওই ডঙ্গল তো জলে যাবে, একবার কানেকশান কাটলে ওই যন্তরটি কেনার পুরো টাকাটাই নষ্ট।” আমি উত্তর দিই, “আমার বাপের অনেক টাকা, টাকার গাছ আছে বলা যায়। এ তো সামান্য কটা টাকা, আমি বোকদণ্ড হিসাবে মেনে নেব।” তারা তবু নাছোড়। বলে কিনা, “স্যর, স্যর, আপনি বরং এই কানেকশানটা কোনও বন্ধু বা আত্মীয়কে দিয়ে দিন। তারা ব্যবহার করুক।” আমি অট্টহাস্য করি, “পাগল, না মাথাখারাপ?” আমি খুব যে বন্ধুবৎসল এমন কথা শত্তুরেও বলবে না। সাড়ে আটটার পর কেউ ফোন করলে ধরি না পর্যন্ত, এমন অসামাজিক আমি। কিন্তু তা বলে জেনেশুনে এমন বাঁশ কাউকে দিতে পারব না। এমন করে কথায় কথায় একমাস কাটিয়ে শেষে একদিন মরিয়া হয়ে বললাম, “প্রিয়ে, এবার যেতে দাও। অনেক কেরামতিই তো দেখলাম। আর কদিন এমন পিরিত টিকে গেলে উকিল খুঁজতে হবে আমাদের বিচ্ছেদ কাহিনি বয়াঁ করতে।” কিন্তু ভবী কখনও ভোলে? সেও মরিয়া। বলল, “প্রভু, আর দু দিন। ব্যস। তারপরও ঠিক না হলে আপনি যেখানে খুশি চলে যান, বাধা দেব না।” আমি অমন কনফিডেন্স শেষ দেখেছিলাম বেঙ্কটেশ প্রসাদের মধ্যে, পাকিস্তানের সঙ্গে একটা বিশ্বকাপ ম্যাচে। যাই হোক, উইকএন্ড ছিল। ক্ষমাঘেন্না করে চারদিন চেপে গেলাম। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই ইন্টারনেটের স্পিড প্রসাদের গতির থেকেও মন্থরতর হয়ে গেল। শেষমেশ আমার গুষ্টি উদ্ধার করছে, এমন একটা হাবভাব দেখিয়ে একমাসের রেন্ট আর কিছু বাড়তি গাঁটগচ্চা নিয়ে তারা কানেকশান কাটার ব্যবস্থা করল। আমিও নতুন আরেক কোম্পানিকে ধরে করে একটা নতুন কানেকশানের ব্যবস্থা করলাম।
কিন্তু আমি বেবফা হলেও, আমার পুরোনো ইন্টারনেটওয়ালারা একদম নবকুমার। অতএব আজ দুপুরে আবার তাদের ফোন। জানতে চাইল, আমি রিস্তা-নাতা ভেঙে কেন দূরে চলে যাচ্ছি। শান্ত গলায় আবার পুরো গল্পটা বললাম। ওদিকে যে ফোনে ছিল, সে নাকি আমার দেশোয়ালি ভাই, বঙ্গালেই থাকে। আর সে জন্যেই সে দরাজ গলায় বলল, “সব পেয়ার-মহব্বতেই এমন একটু-আধটু হয়ে থাকে। কিন্তু তা বলে থোড়িই না সবাই ডিভোর্স চায়।” জানা গেল, সেই মহাশয় প্রথমত প্রসাদেতর কানেকশানকে শোয়েব আক্তার বানাবে। তারপর আমায় আগামী তিনমাস তাদের ইন্টারনেট বিনামূল্যে ব্যবহার করতে দেবে। তারপরও আমি যদি তাদের পরিষেবায় খুশি না হই, তাহলে আমি তাদের কানেকশান পরিত্যাগ করতে পারি। আমি শুনেই পরির মতো নবম মেঘে। ছেলে বলে কী! ওহ! এমন একটা সুযোগ পাব কখনও ভাবিনি। তাই সে যা বলেছিল, সেটাই আবার আমি রিপিট করলাম। “তোমরা আমায় একমাস ভুগিয়েছ। তার ফলে, আমি তোমাদের কানেকশান ছেড়ে দিয়েছি। আর সেটা আটকাতে আমায় তোমরা তিন মাসের ইন্টারনেট ফ্রি দিচ্ছ। তাই তো?” সে ওদিক থেকে স্প্রিংববের মতো ঘটাঘট মাথা নাড়ল, “একদম, একদম। তোমার মতো গুরুত্বপূর্ণ খদ্দেরের জন্যে আমরা এটুকু করতেই পারি।” আমি মনের আহ্লাদটা যতটা সম্ভব চেপে রেখে বললাম, “তোমার অফার খুবই ভালো। কিন্তু সরি জানু, আমি গত একমাস তোমাদের হাতে-পায়ে ধরেছি, তখন তোমরা শোনোনি। এখন আমার একটুও মনে হয় না, আমার মতো গুরুত্বপূর্ণ খদ্দেরকে তোমরা ঠিকঠাক সার্ভিস (ইন টোটাল নন-প্রস্টিটিউট সেন্সে) দিতে পারবে।” বললে পেত্যয় যাবে না, এরপরও সে আরও মিনিটে পাঁচেক আমায় তিন মাসের ফ্রি ইন্টারনেট দেওয়ার জন্যে ঝুলোঝুলি করল। আমিও খচ্চরের মতো খুঁট পেতে দাঁড়িয়ে রইলাম। শেষে সে প্রায় আর্তনাদের সুরেই বলল, “তোমার প্রায় চার হাজার টাকা বেঁচে যাবে, সেটাতেও না বলছ?” আমি হাসি চেপে গম্ভীর স্বরে বললাম, “ছিঃ রমেশবাবু! আমার যে অটুট বিশ্বাসে দাগা দিয়েছ, সেটা এভাবে টাকার অঙ্কে মাপছ?”
ফোনটা রেখে দিয়ে নিজের মনেই খানিকক্ষণ হাসলাম। এই যে একটা বড় কর্পোরেটের মুখের ওপর ‘না’ বলার সুযোগ এল, এই যে বিনা পয়সার নেটের লোভ দেখানো লোকটাকে মুড়ির মতো মিইয়ে দেওয়া গেল, এই যে শেষে শরৎচন্দ্রমাফিক একটা ডায়লগ ঝাড়া গেল (এবং সেটা ফেসবুকে ফলাও করে লেখার ব্যাপারটা ছেড়েই দিলাম) এটা জীবনে কতবার আসে? এমন পুণ্যযোগ পেতে বেশ কয়েকটা চার হাজার ছেড়ে দিতে রাজি আমি।
সেই থেকে মনটা এমন ফুরফরে হয়ে আছে… আহ!
ওমনিস্কোপ
Homepage of Rohon Kuddus
Leave a Reply