বইমেলায় দেখেছিলাম এবং তারপরও সেই ধারা অব্যাহত আছে। অনেকেই বই উপহার দিতে চাইছেন – তাঁদের সদ্যপ্রকাশিত কবিতা বা গল্পের বই (কবিতাটাই বেশি)। আমি এমন কিছু বোদ্ধা পাঠক নই বা যিনি বই দিচ্ছেন, তাঁর পরিচিত বন্ধুও নই। আমি কোনও বইকে ভালো বললে বই বা লেখক বর্তে যাবেন, এমন কেউকেটাও নই। খোঁজ নিয়ে জানলাম, আমার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কিছু ঘটছে না। লোককে সেধে বই বিলোনোর ব্যাপারটা প্রায় সামাজিকতায় পরিণত হয়েছে নব্য বাঙালি সাহিত্যিকদের জন্যে।
তা হোক, কিন্তু যেহেতু কোনও প্রাতরাশই বিনামূল্যে আসে না, তাই ভালোমানুষি করে দাম দিতে এগিয়ে যাই। সেখানেও আরেক বিস্ময় অপেক্ষা করে। সুঠাম, সুমুদ্রিত, সুসম্পাদিত একটি চার ফর্মার বইয়ের দাম গড়ে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা। নিজে যেহেতু বই প্রকাশ করে থাকি, তাই জানি ঐ বই তৈরি করতে কপি পিছু ওরকমই খরচ হয়। সাগ্রহে জানতে চাই – “এত কম পয়সায় বই বেচছেন কী করে?”
উত্তর মূলত এইরকম পেয়ে থাকি।
প্রকাশকঃ লাভের জন্যে বই করি না। সাহিত্য ভালোবেসে বই করি।
লেখকঃ দাম তো প্রকাশক ঠিক করেছে। বেশি দাম রাখলে কেউ বই কিনতেই চাইবে না।
প্রথমে আসা যাক প্রকাশক প্রসঙ্গে। যাদের থেকে এমন উত্তর পাই, সেইসব লিটল ম্যাগ সম্পাদক স্ল্যাশ প্রকাশক সাহিত্যকে ভালোবাসার অবকাশ পাচ্ছেন, কারণ প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই কবি বা লেখকরা বই প্রকাশের যাবতীয় খরচ বহন করে থাকেন। বই বা সাহিত্যকে ব্যবসাতে পরিণত করা তাঁদের নীতিবিরুদ্ধ এবং যারা এটা করে থাকে তারা তাঁদের কাছে ম্লেচ্ছ। এঁদের সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছুই নেই। লিটল ম্যাগের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে তার অর্থনৈতিক দিকটা কতটা শক্তপোক্ত হওয়া দরকার এটা না বুঝলে লিটল ম্যাগ কেন্দ্রিক সাহিত্যের কফিনে পেরেক পোঁতার জন্যে কোনও ‘কর্পোরেট প্রকাশক’-এর আগ্রাসন নীতির দরকার নেই।
এইবার আসি কবি-লেখকদের কথায়, যাঁদের ওপর আমার বিশ্বাস এখনও পুরোপুরি উবে যায়নি। দাম নির্ধারণের দায় প্রকাশকের ওপর চাপিয়ে দিলেও মাথায় রাখতে হবে, তিরিশ-চল্লিশ টাকা খরচ করে তৈরি এক কপি বইয়ের বিক্রয় মূল্য চল্লিশ টাকা রাখার কারণ প্রকাশকের এই বই বিক্রির কোনও দায় নেই, কারণ প্রকাশকের কোনও খরচ নেই। তাই যে কোনও বিক্রেতা বইয়ের ওপর ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমিশন দাবি করলে, সেটাও লেখকেরই পকেট থেকে আসে। আর বইপাড়ার কজন বই বিক্রেতা ঠিকঠাক হিসাব করে বই বিক্রির টাকা ফেরত দেন, সেটার কথা নতুন করে বলার কিছু নেই।
তাহলে উপায়? প্রকাশকের সঙ্গে পরামর্শ করুন। দাম বেশি হওয়ার প্রয়োজন নেই, কিন্তু দাম ন্যায্য হওয়া খুবই দরকার। বইয়ের বিপণনের জন্যে শুধু কলেজ স্ট্রিটে থেমে না থেকে ফ্লিপকার্ট, আমাজনের মত সাইটের সাহায্য নিন। পশ্চিমবঙ্গেও এখন বই বিক্রি করার জন্যে গড়ে উঠছে নতুন নতুন ওয়েবসাইট, সেগুলোই বা কম কীসের? এইসব বিক্রেতার ধার্য কমিশন, বই ভারতের যে কোনও জায়গায় পাঠাতে কুরিয়ার খরচের কথাও মাথা রাখুন। বইয়ের প্রচ্ছদ, অলংকরণ এবং মুদ্রণে ব্যয় হওয়া খরচের সঙ্গে এগুলো যোগ করুন। প্রকাশক যদি প্রিন্টিং প্রেসের থেকে বেশি কিছু দায়িত্ব না নিতে চান, তাহলে নিজেই এই দায়িত্বগুলো কাঁধে তুলে নিন।
প্রাসঙ্গিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে, বই কি শুধুই ইন্টারনেটে বিক্রি হয়? সারা বাংলায় ইন্টারনেট থেকে বই কিনতে না চাওয়া অনেক মানুষ আছেন। সেইসব পাঠকের কাছে কীভাবে পৌঁছনো যায়?
এ প্রসঙ্গে বিদেশী কিছু মডেলকে সামনে রেখে কবি আর্যনীল মুখোপাধ্যায় একটা মেল করেছিলেন। সেই মেল নিয়ে আমি অন্যত্র লিখেছিলাম। আবারও হুবহু আর্যনীলদার ভাষাতেই এখানে তুলে দিলাম। লেখকের বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশের সম্ভাব্য সমাধান পাওয়া যায়।
একদল গ্রীক কবি – মোটামুটি তোমাদের বয়সে। আমাদের মতই ছোট পত্রিকার কবি। নন-মেনস্ট্রীম। প্যারালাল লিটারেচারে বিশ্বাস করে। এরা এই ধরনের একটা জিনিস করছে তাদের বই বেরোলে। তাদের সাথে সম্প্রতি পরিচয় হয়েছে। খুব ভালো লেগেছে তাদের এই পরিকল্পনার কথা শুনে।
আইডিয়াটা বাংলা বাজারের সুবিধার্থে কিছুটা অদল-বদল করে এখানে লিখছি। মূলত বই-যাত্রা। বুক-ট্যুর। এটা কিন্তু আমাদের দেশের ইংরাজী কবিরা বেশ ভালো আকারেই করছেন। তোমরাও চেষ্টা করে দেখো। আমাদের পক্ষে এত দূরে বসে সম্ভব নয়। কিন্তু দূরে থেকে হলেও, যা পারি, যতটা পারি, আমি সাহায্য করব।
মূলত এই রকম। পয়েন্ট করে বলছি।
১। ধরো কারও একটা নতুন বই বের হল।
২। কবি পশ্চিম বাংলার ১০-১৫টা জেলায় তার বন্ধু কোনও কবি বা সম্পাদকদের সঙ্গে যোগাযোগ করলো।
৩। প্রতি মাসে একদিন করে এক-একটা জেলায় কোনও একটা শহরে সে তার নতুন বই থেকে পাঠ করতে চাইলো।
৪। কবির এই বন্ধু সম্পাদকটি তার পড়ার ব্যবস্থা করে দিল। হাউস-রিডিং, হল-ফল ভাড়া করে নয়; চায়ের দোকান, রেলওয়ে প্ল্যাটফর্ম, কারও বাড়িতে ইনফর্মাল কবিতাপাঠ। সেদিন শুধু আমাদের কবি পাঠ করবে, আর কেউ নয়।
৫। কবি, তুমি সেদিন তোমার ১০-১৫ কপি বই নিয়ে যাবে সেই পাঠের অনুষ্ঠানে। কবি, তুমি সেদিন ঐ সম্পাদক ছাড়া আর কাউকে ফ্রি কপি দেবে না। প্রমিস মি। কবি, তুমি সেদিন তোমার সম্পাদক বন্ধুকে বলবে এটা ঘোষণা করতে যে তোমার বই ২৫-৩০% ডিসকাউন্টে সেদিন দেওয়া হবে।
৬। এইভাবে যে বছর বই বেরোবে, সেই বছর ঘুরে ঘুরে যত বেশি পারো জেলায় যাও। অবশ্যই কলকাতা এবং হাওড়া সমেত। যদি সম্ভব হয়, ঢাকাও।
৭। কবি, একবছর পর তুমি বুঝতে পারবে যে, এই এক বছরে অন্তত ২০০ জন লোকের সামনে তুমি কবিতাপাঠ করেছো। অন্তত ২০ ঘন্টা কবিতাপাঠ করেছো। ২৫-১০০ কপি বই বিক্রি হয়ে গেছে। অন্তত ১০টা কাগজে তোমার বইয়ের রিভিউ বেরিয়েছে। আর কী চাই!
এটা কেউ চেষ্টা করে দেখো প্লিজ। এই সমস্ত প্রাইভেট রিডিং-এর ছবি, খবর, ভিডিও, অডিও যা হয় আমাকে পাঠিও। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব সেগুলো সারকুলেট করতে। পশ্চিমের একাধিক তরুণ কবিরা এইভাবে বুক-ট্যুর করছে। হয়তো এভাবেই নয়। প্রায় এভাবে। এই ভ্রমণগুলো থেকে তোমার পশ্চিমবঙ্গটাও অনেকটা দেখা হয়ে যাবে। অনেক নতুন বন্ধুও হবে হয়তো।
প্রিয় কবি-লেখক, এই সম্পাদকীয়তে এখনও থাকলে দয়া করে বোঝার চেষ্টা করুন বইও একটা পণ্য। তার দুই মলাটে বন্দি সাহিত্য আপনার কষ্টার্জিত ফসল। সেই মেধা ও শ্রম অনাদরে বিলিয়ে দেওয়ার পেছনে আদৌ কোনও যুক্তি আছে কি? বই বেচে আপনার সংসার চলুক, সে প্রার্থনা আমার নয়। কিন্তু ক্রয়-বিক্রয় যদি অর্থনীতির সহজ লাভ-লোকসানের হিসাব না মেনে হয়, তাহলে অন্য যে কোনও শিল্পের মতই সাহিত্যসেবী প্রকাশকদের এই বই প্রকাশনাও একদিন হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়তে বাধ্য। কবি-লেখকদের পকেটের পয়সায় বই ছেপে আখেরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং হবে বাংলা সাহিত্যের গর্ব লিটল ম্যাগ কেন্দ্রিক সাহিত্যই।
1
October 22, 2014
Baparta thik bujhte parlamna