গুরুদেব আর ভাণ্ডারীর সেই গল্পটা মনে আছে? সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন।
ভাণ্ডারী নামের মহারাষ্ট্রের এক ছেলে এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে। তাঁর দিদিমা বা ঠাকুমা কেউ তাঁকে একটা আট আনা দিয়েছিলেন ফকির বা দরবেশকে দান করার জন্যে। ভাণ্ডারী শান্তিনিকেতনে পৌঁছেই এক দরবেশকে পাকড়াও করে সেই আট আনা দান করেছিলেন। বেচারা ভাণ্ডারী! সেই দরবেশবেশী মানুষটা ছিলেন রবি ঠাকুর।
গল্পটার অবতারণা করার কারণ কী?
এই বইমেলায় আমার সঙ্গে ছায়ার মতো যে ছেলেটি ছিল সবসময় তাকে অনেকেই দেখেছেন স্টল ৪৬৫-তে। তৌফিক। ছেলেটি হাসিখুশি, স্মার্ট, সৎ। দোষের মধ্যে শুধু কারও হাতে খুচরো টাকা দেখলেই চেয়ে বসত। আমাদের স্টলে রোজ খুচরো নোটের টানাটানি হত বলে সে তার বাড়ির আশেপাশের মুদি দোকান থেকে শ পাঁচেক টাকার খুচরো আনত। তাতেও না কুলোলে আমাদের স্টলের ক্রেতাদের হাতে বা পার্সে খুচরো দেখলেই মাঝে মাঝে অনুরোধ করত – “আপনার খুচরোগুলো দেবেন প্লিজ?”
ব্যাপারটা একদিন বেশ মজাদার জায়গায় পৌঁছে গেল। সেদিন অন্যান্যদিনের তুলনায় তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেছি স্টলে। বই-টই গোছাচ্ছি। তৌফিক জলবিয়োগ করতে টয়লেটের দিকে হাঁটা দিয়েছিল। একটু পরেই সে হন্তদন্ত হয়ে ফিরল – “রোহণদা, একটা ব্যাপার হয়েছে।” আমি সরু চোখে জরিপ করলাম।
কী হতে পারে? টয়লেটে পাশের লোকটা ওর পায়ে হিসি করে দিয়েছে? নাকি ওয়াশ বেসিন থেকে জল ছিটিয়ে প্যান্ট ভিজে গেছে। পর্যবেক্ষণে বুঝলাম, দুটোর কোনওটাই ঘটেনি বোধ হয়। তাহলে?
তৌফিক খোলসা করল।
আমি টয়লেট থেকে ফিরছি। দেখি একটা স্টলের সামনে একজন কাকু বসে অনেকগুলো দশ টাকার নোট গুনছে। আমি বললাম – “কাকু, কিছু খুচরো দাও আমায়।” তো সেই কাকু বলল – “আমাদের স্টল আছে, লাগবে।” আমিও বললাম – “আমাদেরও স্টল আছে।” কাকু জিজ্ঞাসা করল – “কোন স্টল?” আমি বললাম – “৪৬৫।” তখন কাকুটা বলল – “সম্পর্ক?” আমি বললাম – “না। সৃষ্টিসুখ।” তখন কাকুটা হেসে বলল – “ও। রোহণদের।” তোমার নাম বলতে সন্দেহ হল। মুখ তুলে স্টলের নাম দেখি কৌরব। কাকুটা আমায় আবার জিজ্ঞাসা করল – “তুমি কবিতা লেখো?”
কবিতার আশেপাশে না গেলেও কৌরব নাম দেখে তৌফিক তড়িঘড়ি হাঁটা লাগিয়েছে খুচরোর মায়া ছেড়ে। কে জানে, হয়তো কবিতাই লিখতে হবে এই কাকুর পাল্লায় পড়ে।
এই গল্পটা এবারের বইমেলা থেকে আমার জন্যে একটা উজ্জ্বল স্মৃতি। হয়তো কৌরবের সামনে যে ‘কাকু’ রোজ চেয়ার নিয়ে বসতেন, তাঁর জন্যেও।
2
Leave a Reply