ছোটবেলায় দুটো ছবি আঁকায় আমি বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছিলাম।
প্রথমটা দূর্গাপুজোর। দেবী দূর্গার দুদিকে দাঁড়িয়ে তাঁর ছেলেমেয়েরা। পায়ের তলায় অসুর। দেবীর দশ হাতে দশটা অস্ত্র আর তাঁর বাহন সিংহ আঁকতে সবথেকে বেশি ভালো লাগত। বাড়িতে আমার পছন্দের কেউ এলে তাঁকে ছবিটা লাইভ এঁকে দেখাতাম। তাই আমাদের নিয়মিত অতিথিদের সবারই প্রায় সে ছবি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল।
আমার আঁকা দ্বিতীয় জনপ্রিয় ছবিটা ছিল একটা ফুটবল ম্যাচের। আকাশী-সাদা ডোরাকাটা দশ নাম্বার জার্সির একটা লোক গোল দিচ্ছে। গোলকিপার বলটা ধরতে উড়ান দিয়েছে বটে গোলপোস্টের ডানদিকে, কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে যে বলটা আটকাতে পারবে না। আকাশী-সাদার বাকি দশজন আনন্দে হাত শূন্যে ছুঁড়ে দিয়েছে। আর অন্য দলটি (যাদের জার্সির রঙ আমার মর্জি মতো কখনও নীল, কখনও কমলা, কখনও সবুজ, কখনও হলুদ; কাদের হারাতে চাইছি, তার ওপর নির্ভর করত) হতাশায় মাথায় হাত দিয়ে ফেলেছে। গোলকিপার বাদ দিয়ে দশজনেরই মাথায় হাত। ঐ ছবিটা ছিল সদ্য সমাপ্ত বিশ্বকাপের ফাইনালের এক কাল্পনিক মুহূর্ত।
২০১৪-র আগে সত্যি করে ঐ একবারই বিশ্বকাপ ফুটবল দেখেছি। ১৯৯০-এ তখন বয়স কত আমার? সাত। বিশ্বকাপ শুরুর আগেই আনন্দমেলা অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর তথ্য, আগের বিশ্বকাপগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ, নব্বইয়ের বিশ্বকাপের তারকাদের হাল-হকিকত ইত্যাদি নিয়ে একটা বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিল। আহা! তেমন সুন্দর বিশ্বকাপ সংখ্যা আজও চোখে পড়ল না। বিশ্বকাপ শুরুর আগেই মারাদোনা-ক্যানিজিয়া, ভালদেরামা, গুলিট-বাস্তেন, লোথার ম্যাথেউজ, বাজ্জিও-স্কিলাচি এঁদের নানা খুঁটিনাটি বলে ক্লাসে তাক লাগিয়ে দিতাম। তবে এঁদের থেকেও সবচেয়ে বেশি মন কেড়েছিল ঐ বিশ্বকাপের ম্যাসকট। ইতালিতে হয়েছিলে সেবারের প্রতিযোগিতা। তাই ইতালির জাতীয় পতাকার রঙে রাঙানো তিন রঙের কিউব দিয়ে বানানো একটা কাঠিমানুষ, পায়ের বদলে তার মাথায় বসানো বল। তারপর বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার পর রজার মিল্লা, হিগুইতা (ওহ! হিগুইতা, এক পাগল), গয়কোচিয়া আরও কত নতুন তারকার নাম জানলাম। প্রায় প্রতিটা খেলাই নিয়ম করে দেখা হত বাড়িতে। যদ্দূর মনে পড়ে সন্ধ্যায় একটা খেলা হত, রাতে আর একটা। সন্ধেবেলার খেলা দেখব বলে আগেভাগে স্কুলের হোমওয়ার্ক সেরে রাখতাম। অনেক সময় বিকালের খেলাও তার জন্যে জলাঞ্জলি দিতাম। আর প্রতিটা খেলা শেষ হলেই আনন্দমেলার সেন্টার ফোল্ডে গিয়ে ম্যাচের স্কোর লিখতাম।
আমার পছন্দের তারকা ছিলেন অবশ্যই মারাদোনা। কারণ ছিয়াশিতে আমাদের গ্রামের বাড়িতে যখন টিভি আসে, যে লোকটার কথা সবাই বলত, যাকে সবাই দেখতে চাইত, তিনি মারাদোনা। তার পরের চার বছরও ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে কোনও কথা উঠলেই তার শুরু বা শেষ হত মারাদোনাকে দিয়েই। মায়েরও বোধহয় মারাদোনাকে একটু-আধটু ভালো লাগত, কিন্তু মারাদোনা বা আর্জেন্টিনার জন্যে কখনও সেভাবে গলা ফাটাতে দেখিনি। আর বাপির পছন্দ বরাবরই ইতালি। এদের মধ্যে এক ঘরে বসবাস করেও শুধুমাত্র মারাদোনার জন্যেই কীভাবে যেন আমি আর্জেন্টিনার ফ্যান হয়ে গেলাম। পাড়া-পড়শির প্রভাবও হয়ত ছিল কিছুটা। আমরা তখন বাগনানে একটা ভাড়াবাড়িতে থাকতাম। সন্ধেবেলা অনেকেই আমাদের বাড়ি খেলা দেখতে আসতেন। তাঁদের জন্যে বাইরের উঠোনে টিভিটা বের করে দেওয়া হত। এমনই এক সন্ধেবেলা আর্জেন্টিনা এক গোলে ব্রাজিলকে হারিয়ে দিল। জনগণের আনন্দে টের পেলাম ব্রাজিলের হার একটা বিশেষ ঘটনা। সত্যি বলতে কী, আর্জেন্টিনা যে ব্রাজিলকে হারাতে পারবে এমনটা আমার মত অতি বড় মারাদোনা-ভক্তের জন্যেও বেশ সন্দেহের ব্যাপার ছিল। কারণ ব্রাজিল গ্রুপের সব ম্যাচ জিতে সেকেন্ড রাউন্ডে উঠেছিল। আর আর্জেন্টিনা সেখানে প্রথম ম্যাচেই হেরেছিল ক্যামেরুনের কাছে। তারপর একটা জিত, একটা ড্র। সে বিশ্বকাপে মোট চব্বিশটা দল ছিল। তাই ছটা গ্রুপের প্রথম দুই দলের সঙ্গেই পয়েন্ট আর গোল-ব্যবধানের বিচারে চারটে গ্রুপের তৃতীয় স্থানাধিকারীরাও পরের রাউন্ডে গিয়েছিল। আর্জেন্টিনাও ঐভাবেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছিল। যাই হোক, তখন ছোট ছিলাম তো, তাই ব্রাজিলের হারের থেকেও আমার বেশি আনন্দ হয়েছিল আর্জেন্টিনা জেতায়। আন্ডারডগ, বিশেষত যদি নিজের দল হয়, জিতলে খুশি এখনও আঠারো আনা। আর্জেন্টিনার পরের খেলাটা আর মনে নেই সেভাবে। সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বা লোডশেডিং চলছিল। যাই হোক, যুগোশ্লাভিয়াকে টাইব্রেকারে হারিয়ে মারাদোনার দেশ গিয়ে পড়ল ইতালির সামনে। ইতালি প্রথম রাউন্ডে সব ম্যাচ জিতেছিল। সেকেন্ড রাউন্ড বা কোয়ার্টার ফাইনালেও তাদের তেমন বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু আর্জেন্টিনাকে নিয়ে আমার চারপাশের মানুষজনের উন্মাদনা তখন চরমে। আমি তখন বাগনান থেকে আমাদের গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। তখন সেখানে টিভি ছিল না। ছিয়াশির বিশ্বকাপের পরপরই পাড়ার একমাত্র টিভিটা দেখার জন্যে প্রচুর মানুষজন (বিশেষত শনি-রবিবার) ভিড় করতেন। আমার দাদুনের এই ঝুট-ঝামেলা পছন্দ না হওয়ায় বাড়ি থেকে টিভি বিদায় নিয়েছিল। যাই হোক, জনিদার সঙ্গে আমাদের পড়শি মানিককাকুর বাড়ি খেলা দেখতে গেলাম। ইতালি প্রথমদিকে গোল দিয়ে এগিয়ে গেল। তারপর গোল আর হয় না। মারাদোনার ম্যাজিক ইতালির রক্ষণে বারবার বানচাল হয়ে যাচ্ছে। আমি মনে মনে নিজেকে স্বান্তনা দিচ্ছি, ‘যাক, ইতালি জিতলে বাপি অন্তত খুশি হবে।’ খেলা প্রায় শেষের দিকে, নিজের স্বান্তনাই চোখের জল হয়ে বেরোবে-বেরোবে করছে, এমন সময় ক্যানিজিয়া গোলশোধ করলেন। তারপর আবার সেই টাইব্রেকার। আবার গয়কোচিয়া ম্যাজিক। আবার আর্জেন্টিনার জিত। পুরো টুর্নামেন্টে মারাদোনার একমাত্র গোল ছিল ঐ সেমিফাইনালের টাইব্রেকারেই। কিন্তু গোল না করেও একটা লোক পুরো একটা দলকে কীভাবে টেনে নিয়ে যেতে পারেন, তার প্রথম উদাহরণ হিসাবে মারাদোনাকেই দেখেছিলাম।
ফাইনালের আগে আমি আবার বাগনানে ফিরে এসেছিলাম। ইতালি না জেতার জন্যে বাপির মন খারাপ ঠিকই, কিন্তু মারাদোনাকে কে না ভালোবাসে। তাই রাতদুপুরে উঠোনে টিভি বের না করতে পেরে আমাদের এক চিলতে বারান্দায় সবাই বসে গেল টিভি নিয়ে। সেমিফাইনালে এবং তার আগে পরপর দুটো হলুদ কার্ড দেখার জন্যে সম্ভবত ক্যানিজিয়া বা বুরুচাগা, কেউ একজন ফাইনালে খেলছিলেন না। সে নিয়েও কেউ কেউ উদ্বিগ্ন। পুরো ম্যাচে গোল না হওয়াতে একটু ঢুলুনি আসছিল, এমন সময়ই একটা পেনাল্টি দেওয়া হল আর্জেন্টিনার বিপক্ষে এবং গোল। আমার প্রথম বিশ্বকাপে আমার দল ফাইনালে উঠে এক গোলে হেরে গেল। দারুণ কষ্ট হয়েছিল। মারাদোনা কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়ছেন। আমার জন্যে সে ছিল এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। ১৯৯৪-এর বিশ্বকাপও ছিল মারাদোনা পর্যন্তই। ড্রাগ কেলেঙ্কারিতে মারাদোনার নির্বাসনের সঙ্গে সঙ্গেই আমারও বিশ্বকাপ দেখা শেষ হয়ে গেল পরের দুটো দশকের জন্যে।
পরে আন্দ্রে ব্রেহমে বলেছিলেন ফাইনালের ঐ পেনাল্টিটার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল, আসলে ফাউলই হয়নি নাকি। কিন্তু আরও পরে জেনেছিলাম, সেকেন্ড রাউন্ডে ব্রাজিলের ম্যাচটায় হাফটাইমে মারাদোনা একটি অপকর্ম করেছিলেন। ব্রাঙ্কো নামের ওদের এক ডিফেন্ডারকে জলের সঙ্গে হালকা ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিলেন, মারাদোনা নিজেই স্বীকার করেছিলেন পরে। তাই ব্রাজিলের ডিফেন্স চিরে ওনার সেই চোখ-ধাঁধানো দৌড় এবং তারপর ক্যানিজিয়ার গোলেও ভেজাল ছিল কিছুটা। ফলত বিশ্বকাপ থেকে ব্রাজিলের ছিটকে যাওয়াও অনৈতিক ছিল বৈকি। নব্বইয়ের বিশ্বকাপ মারাদোনার হাতে না ওঠায় তখন কষ্ট পেয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু পরে নিজেকেই বুঝিয়েছিলাম, একেই বলে ‘হুড়কের দান কুড়কেতে যায়’ বা বড়দের ভাষায় poetic justice – খারাপ করলে, খারাপ হবে।
কিন্তু এতসব কিছু জেনেও এখনও মাঝে মাঝেই আমি মারাদোনাকে স্বপ্নে দেখি। মারাদোনা কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছেড়ে টিভি থেকে বেরিয়ে মানিককাকুর বাড়ির বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। আমি মারাদোনাকে বোঝাচ্ছি – “খেলায় তো হারজিত থাকেই বলো। কেঁদে কিছু লাভ আছে?” তারপর একটু থেমে বলি – “চলো সাইকেল চড়ে বেড়িয়ে আসি।” আমার মন খারাপ হলে ছোট-নদা আমায় সাইকেলে করে ঘুরিয়ে নিয়ে আসত। বাপির সাইকেল নিয়ে মারাদোনাও আমায় নিয়ে সেভাবেই ঘুরছেন আমাদের গ্রামের রাস্তায়। আমি পেছনে বসে চ্যাঁচাচ্ছি – “থ্রি চিয়ার্স ফর আর্জেন্টিনা!” মারাদোনা যোগ করছেন – “হিপ হিপ…” আমি পাদপূরণ করছি – “হুররে-এ-এ-এ।”
1
July 15, 2014
ভাল লাগলো, বেশ ভাল। একটা কথা খুব মুখে মুখে ঘুরতো– মারাদোনা কাটাপোনা……
July 15, 2014
হে হে… এটা শুনিনি তো। বেশ মজা পেলাম। 😀
August 5, 2014
ওমনিস্কোপে একটা ঈদ স্পেশাল আশা করেছিলাম রোহণদা…… নতুন লেখা চাই 🙂
October 21, 2014
Ami kintu dadar fan hoye jache dheredhere
August 10, 2015
Amaro erokom ghote6ilo rohon da.ei world cup, ami Portugal er fan chhilam, obbosoy Ronaldo r jonno. Ami maje maje sopner moddhe ronaldo k boli “carry on ronaldo ,wcup hoi ni to ki hye6e ,club a6e to”.Amio wcup er somoy messi ,ronaldo, suarez,klose,etc. niye khub alochona kortam . bed er samne ronaldo r chhobi lagie raktam.
Pore darun laglo.
September 7, 2015
Glad to know 🙂