চাদ্দিকে কেমন একটা ভোট-ভোট ভাব। কেউ কার্টুন আঁকছেন, কেউ মেমে, কেউ বা ছড়া লিখছেন। কেউ কেন সিপিয়েম বা তিনোমুলকে ভোট দেবেন বা দেবেন না এসব লিখছেন। কেউ আবার নিরপেক্ষ বামবিরোধী, কেউ বা ধর্মনিরপেক্ষ বিজেপি। আমি এসবের কোনওটাই নই। সেই ছোটবেলা থেকেই আমি আদ্যন্ত নির্ভেজাল সিপিএম। পঞ্চায়েত ভোটের মিছিলের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে আর ‘জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ’ চেল্লাতে চেল্লাতে বাড়ির কাছাকাছি মিছিলটা এলে টুক করে এক গ্লাস গ্লুকোজ খেয়ে হাঁটা দিতাম আবার। তারপর তো হোস্টেলে ভর্তি হয়ে গেলাম ক্লাস ফাইভ থেকে। আমার রাজনৈতিক কেরিয়ারে অকাল যবনিকাপাত ঘটল।
তবে একবারের ঘটনা বলি। সেটাও পঞ্চায়েত ভোট। একটা বুথ হয়েছে হোস্টেলের পাশের প্রাইমারি স্কুলে। সকাল থেকেই এজেন্টরা বসে গেছেন তক্তপোশ পেতে। এজেন্ট মানে সিপিএম-এরই শুধু। কংগ্রেসী লোকজনের (তখনও তৃণমূল ছিল না, বা থাকলেও টিমটিমে ব্যাপার, মনে নেই ঠিক) বাড়িতে তক্তপোশ ছিল না বা থাকলেও তার পায়া ছিল না। মোট কথা, তারা রবাহুতের মতো মাঝে মাঝে এদিক-সেদিক ঘুরছিল বটে, তবে সেভাবে পাত্তা পাচ্ছিল না। হঠাৎ দেখি, ক্লাস টেনের এক দাদা ভোট দিয়ে এক গাল হেসে বের হচ্ছে। কী ব্যাপার! সে কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, “কে একজন নাকি আমেদাবাদ গেছে। সোনার কাজ করে। তা সে তো আসতে পারবে না। এরা আমায় ধরল তার ভোটটা দিয়ে দিতে।” আমি অবাক হয়ে এবার তক্তপোশে বসা লোকজনের দিকে দেখলাম। একটু পরে দেখি অনেকেই ভোট-টোট দিয়ে বের হচ্ছে। এক-একজন দু-তিনবারও ভোট দিয়েছে দেখা গেল। তিন আঙুলে তিনটে কালির আঁচড়। এমনকী আমার আজন্ম (মানে হোস্টেল জন্মের শুরু থেকে) বান্ধব সাহিদদাও মাথা নাড়তে নাড়তে দুটো ভোট দিয়ে এল। স্বভাবতই আমার বুকের মধ্যেও ইচ্ছেটা চাগাড় দিয়ে উঠল। আমি একজনকে গিয়ে ভারিক্কি স্বরে বললাম, “আমিও ভোট দিতে চাই।” একবার আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে দু-চারজন খ্যা-খ্যা করে হাসতে শুরু করল। আমি তখনও চোয়াল এঁটে দাঁড়িয়ে আছি দেখে একজন গলাটা কোমল করে বলল, “দ্যাখ বাপি, তোর বয়স হয়নি এখনও।” আমি তখন সবে ফুলপ্যান্ট পরা শুরু করেছি। অতএব বয়সের গল্প গিয়ে আর কাউকে দাও। মরিয়া বললাম, “সাহিদদা তো আমার থেকে মোটে এক বছরের বড়। সে যে দিয়ে এল বড়?”
তর্কটা আর একটু এগোনো যেত। কিন্তু হঠাৎ করে দেখি একদিক থেকে লোক দৌড়চ্ছে। সাহিদদা কাছেই ছিল কোথাও। আমার দিকে দৌড়তে দৌড়তে বলল — “পালাও। পুলিশ।” আমি জীবনেও পুলিশকে ভয় পাইনি। কেজি স্কুলে পড়তে আমাদের স্কুলগাড়ি প্রতিদিন বাগনান থানার কম্পাউন্ডে ঢুকত। সেখান থেকে কোনও পুলিশকাকুর মেয়ে উঠত। তা গাড়ি ঢোকা আর বের হওয়ার মাঝে প্রায় রোজই ভবানী নামের খাকি বারমুডা পরা একজন পুলিশ আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে আসত। মাঝে মাঝে সে নানা চুটকি শোনাত। তাই মনে মনে সব পুলিশের সঙ্গেই আমার ভবানীমাফিক সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এক সেকেন্ড পরেই দেখলাম আমার সামনে পুলিশের লাঠি পড়ল একজনের মাথায়। যঃ পলায়তি, সঃ জীবতি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে চোঁ-চাঁ দৌড়ে সাহিদদাকে ক্রশ করে ক্লিন পঞ্চাশ গজ মেরে দিলাম। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম পেছনে দক্ষযজ্ঞ চলছে। দুমদাম লাঠি পড়ছে।
ব্যাপারটা গোলমেলে সন্দেহ নেই। নকল ভোট পড়ছিল সকাল থেকেই। কিন্তু কোনও কংগ্রেসী এজেন্ট বোধ হয় চুকলি করেছিল। পরে সেটা ওপরমহলে (কাদের ওপরমহলে সে নিয়েও নানা মত ছিল) যায়। সেখান থেকে আর কেউ পুলিশকে ধ্যাতানি দেয় এবং পুলিশ ভীম ভবানী মূর্তি ধারণ করে ইত্যাদি ইত্যাদি।
সাহিদদা এবং তার মতো ছাত্র-ভোটদাতাদের সবাই-ই পুলিশের লাঠি থেকে বাঁচলেও আমাদের সুপারিন্টেনডেন্ট হাসেম স্যরের ছড়ি থেকে বাঁচতে পারেনি। আঙুলের দাগ দেখে চুন-চুনকে ঠ্যাঙাচ্ছিলেন। পার ভোট দশ ঘা। পরে হাঁফিয়ে গিয়ে প্রেয়ার হলের পাবলিক এ্যাড্রেসিং সিস্টেম থেকে ঘোষণা করলেন, যারা নিজে থেকে এসে মার খেয়ে যাবে, তাদের জন্যে ভোট পিছু পাঁচ ঘা পড়বে। কিন্তু ফিফটি পারসেন্ট ডিসকাউন্টের এই স্কিমে বিশেষ সাড়া মেলেনি। বিকেলে আসরের নামাজের শেষে প্রেয়ার হলের একটা দরজা খোলা রেখে আবার উনি ছড়ি নিয়ে বসেছিলেন।
যাই হোক, সেইদিন এবং পরেরদিন ওই এলাকায় কার্ফিউ চলেছিল। আমাদের রাঁধুনিরা সবাই আসতে না পারায় হোস্টেলেও খাওয়া-দাওয়ার বেশ সমস্যা হয়েছিল। আমার মতো যারা ভোট দিতে পারেনি, তারা সাহিদদার মতো দুর্নীতিপরায়ণ এবং গণতন্ত্রের হত্যাকারীদের (এই দুটোই আমিই ব্যবহার করেছিলাম, বাকিদের গুলো লেখা যায় না, ফ্যামিলি অডিয়েন্স আছেন, মানে আমার ফ্যামিলি আর কী) লোকজনকে বেশ চোখা চোখা কথা শুনিয়েছিল।
তবে আমার ব্যক্তিগত মতে, সিপিএম জমানায় এমন ঘটনা বেশ ব্যতিক্রমী ছিল। ভোটকেন্দ্রে সাধারণত পুলিশি গোলমাল হত না, নির্বাচন অবাধ এবং শান্তিপূর্ণই হত। শেষ পাঁচ বছর খবরের কাগজে এবং চ্যানেলে তৃণমূলের গা-জোয়ারি দেখে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। ভোট করানোটাও যে একটা ধ্রুপদী শিল্প, সেটা সিপিএম করে দেখিয়েছিল। এখন কেষ্টই করাক আর ভাইপোই করাক, সেই সূক্ষ্ম কারিকুরি আয়ত্ত করা এদের মতো মাথামোটাদের পক্ষে কোনওদিনই সম্ভব নয়। সিপিএম-এর সঙ্গে সঙ্গেই রাজ্য থেকে শিল্পের দিন সত্যিই গেছে।
Leave a Reply