গতকাল সকালে অফিস যাওয়ার সময় দরজায় চাবি দিতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম কিছু একটা গড়বড় হয়েছে। চাবিটা পকেটে নেই, বস্তুত পকেটের জায়গায় পকেটটাই নেই। ব্যাপারটা কী হয়েছে যখন প্রায় ৯০ শতাংশ আন্দাজ করে ফেলেছি, রিনরিনে গলায় প্রশ্ন এল – “Uncle, where is your pants?” মুখ ঘুরিয়ে দেখি সাত সকালেই ভয়ের বাঘ দাঁড়িয়ে আছে, আমার প্রতিবেশীর পুত্ররত্ন লবেঞ্চুস। লবেঞ্চুসের আসল নাম কী তা জানি না। কিন্তু আমার সঙ্গে তার লবেঞ্চুসের মধুর সম্পর্ক। অথচ কদিন আগেও তাকে আমি এড়িয়ে চলতাম। গল্পটা বিশদে বলি।
লবেঞ্চুসের কাছে আমি দারুণ সন্দেহজনক একটা চরিত্র। সে ঘুম থেকে উঠে দেখে একটা লোক পিঠে ব্যাগ নিয়ে কোথাও যায়। আর ঘুমোতে যাওয়ার সময় দেখে সে লোকটা আবার ব্যাগ কাঁধে ফিরে আসছে। সারাদিন লোকটার ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ থাকে। লোকটার সঙ্গে আর কেউ থাকেও না। লোকটা রহস্যময়!
লবেঞ্চুসের এই বয়সে আমিও আমাদের পাড়ার পিন্টুর বাবাকে ডাকাত ভাবতাম। লাল লাল চোখ নিয়ে ভদ্রলোক চুপচাপ হেঁটে যেতেন রাস্তা দিয়ে। কাউকে কিচ্ছুটি বলতেন না মুখ ফুটে, অথচ সব কাজ হয়ে যেত। চায়ের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালে আপনা থেকেই তাঁর সামনে চলে আসত চায়ের গেলাস। রিক্সায় উঠে বসলে রিক্সাওয়ালা কাকু কিছু না জিজ্ঞাসা করেই সাঁই-সাঁই প্যাডেল করে তাঁকে নিয়ে কোথায় যেন চলে যেত।
মাসখানেক আগে রবিবারের দুপুরে ভাত খাচ্ছি, দেখি বারান্দার জানালার শার্সিতে একটা গোল ছায়া। বুঝলাম লবেঞ্চুসের মাথা। তার পেছনে যোগ হল অপেক্ষাকৃত লম্বা ছায়া। অস্পষ্ট কিছু আওয়াজে মালুম হল লবেঞ্চুস এখন সারা বারান্দায় ঘুরে ঘুরে তার লাঞ্চটুকু খেয়ে তার মাকে ধন্য করছে। হঠাৎ শুনি সে তার মাকে বলছে – “Mummy, he is a detective.” লবেঞ্চুসের মুখে সেই প্রথম ইংরাজি শোনা আমার। তার বাবা-মা তামিল জানি। তাও সে মায়ের সঙ্গে ইংরাজিতে কথা বলছে শুনে অবাক হতে পারেন। আমার মত যারা সামান্য চালাক, তারা হয়ত ভেবে বসবেন তামিলের মত অমন একটা জটিল ভাষা বাচ্চা ছেলে এখনও আয়ত্ত করতে পারেনি। কিন্তু আসলে ব্যাপার অন্য। বড় শহরগুলোর এটা একটা ঘ্যাম ব্যাপার। এখানে বাবা-মাগুলো বাচ্চা ছেলে আর বড় কুকুরগুলোর সঙ্গে ইংরাজিতেই কথা বলেন। ফলে বাচ্চারাও মা-বাবার সঙ্গে ইংরাজিতেই কথোপকথন সারে। এমনকী কুকুরগুলোও দেখি ‘ঘেউ ঘেউ’ না করে ‘উফ উফ’ ডাকে। যাই হোক, আমার এহেন রোমাঞ্চকর জীবিকাপ্রাপ্তিতে লবেঞ্চুসের মায়ের উত্তর কী হয় জানার জন্যে কান খাড়া করে থেকেও বেশি কিছু বুঝতে পারলাম না। তবে বুঝলাম মায়ের উত্তরে লবেঞ্চুসের উষ্মা বেড়ে গেল – “But he has a big gun.”
বুঝলাম, আমি হলাম গিয়ে লবেঞ্চুসের পিন্টুর-বাবা-কাকু।
আরও সপ্তাখানেক পরে দেখি আবার জানালার কাচে গোল ছায়া আর সঙ্গে টুকুটুক আওয়াজ। আমি গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম – “What?” লবেঞ্চুস ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল – “Are you dead?” আমি একই স্বরে উত্তর দিলাম – “I am dead now.” ছায়াটা সরে গেল।
আমাদের মধ্যে গোয়েন্দা-সন্দেহভাজন টাইপের সম্পর্কটা ভেঙে গেল আরও কদিন পর। সেদিন টিভি সারানোর মিস্ত্রি আসবে বলে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসেছি। সিঁড়ি থেকে উঠছি, আচমকা ফুটবলের মত সামনে উড়ে এল লবেঞ্চুস। আমি প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় তাকে পাকড়াও করলেও, তার ধাক্কায় দু-তিনটে সিঁড়ি গড়িয়ে গিয়ে স্থির হলাম। কোমরে একটা ক্ষীণ ব্যথা টের পেলাম। আর আমার কোলে বসে লবেঞ্চুস তখন প্যাঁ জুড়েছে। আওয়াজ শুনে তার মা এসে হাজির। আমি ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলে লবেঞ্চুসকে তার মায়ের হাতে তুলে দিতেই তার পিঠে একটা ধাঁই পড়ল। ইংরাজি নয়, বিশুদ্ধ তামিলে তার ওপর বোমাবর্ষণ আরম্ভ হল। বুঝলাম, সিঁড়িতে না খেলার জন্যে তাকে আগেও বারণ করা হয়েছে। লবেঞ্চুস হাঁই-হাঁই কাঁদছে দেখে মায়া লাগল। যদিও লবেঞ্চুসের সঙ্গে আমার খুব একটা দোস্তি নেই। এবং তার কৃতকর্মের জন্যে আমার কোমরে বেশ লেগেওছে। তবু মনে হল, পুরো ব্যাপারটায় কোথাও যেন আমার কিছু করার ছিল। লবেঞ্চুসের মাকে যদি বলতাম আমি আর লবেঞ্চুস সিঁড়ি সিঁড়ি খেলছিলাম, তাহলে হয়ত বেচারা মার খেত না।
প্রায়শ্চিত্তের জন্যে পরের দিনও তাড়াতাড়ি ফিরলাম। দেখি লবেঞ্চুস সিঁড়িতে বসে একটা খেলনা গাড়িকে আস্তে আস্তে খাদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আমি পাশে বসতেই সে তটস্থ হয়ে উঠল। আমি পকেট থেকে একটা লজেন্স বের করে গালে পুরলাম। তারপর তার দিকেও একটা এগিয়ে দিলাম। এরপর থেকে সপ্তায় প্রায় রোজই লবেঞ্চুস আমার থেকে একটা করে লজেন্স পেয়ে থাকে। আমি অফিস যাওয়ার সময়টাই এই লজেন্স আদানপ্রদানের জন্যে আদর্শ। তাই প্রতিদিন সকালেই আমার দরজা বন্ধ করার আওয়াজে শ্রীমান লবেঞ্চুস এসে হাজির হয়। গতকাল সকালেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
এখান থেকে যারা লেখাটা পড়তে শুরু করলেন, তাঁদের জানাই লবেঞ্চুসের প্রশ্ন ছিল – “Uncle, where is your pants?” আমি বুঝলাম ক্ষতি যা হওয়ার হয়েই গেছে। এখন ড্যামেজ কন্ট্রোল কতটা করা যায় সেটাই দেখার। কিন্তু তার জন্যে পরিস্থিতি কি অনুকূল? জরিপ করে দেখলাম, আমার অবস্থা হরপ্পা-মহেঞ্জেদড়ো। অর্থাৎ প্যান্টের থেকে জামাটা বেশ বড়। অর্থাৎ মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে কথা বলাই যেতে পারে লবেঞ্চুসের সঙ্গে। তাই মুখটা যতটা পারা যায় হাসি-হাসি করে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম – “You know what day it is?” লবেঞ্চুস মাথা নাড়ল – “Friday.” আমি বুক ঠুকে বললাম – “Yes, Friday. And you know what that means?” লবেঞ্চুস এবার দুদিকে মাথা নাড়ল। “That means No Pants Day. Friday is the No Pants Day.” লবেঞ্চুস গোল গোল চোখে জিজ্ঞাসা করল – “Really?” আমি জুতো খুলতে খুলতে উত্তর দিলাম – “Yes little man. Now if you please excuse me. I forgot my gun today.” ঘরে ঢোকার আগে ব্যাখ্যা করে দিলাম একবার – “I carry my gun in my pocket. You know… today no pants, so forgot my gun.” লবেঞ্চুস আনন্দে আটখানা হয়ে ‘ইয়ে-এ-এ-এ’ আওয়াজ তুলে তাদের ফ্ল্যাটের দিকে দৌড় দিল। ভাবলাম, আমার বন্দুকের প্রত্যয়িত স্বীকারোক্তি সে তার মাকে শোনাতে গেছে।
যাই হোক, ঘরে ঢুকে প্যান্ট-ট্যান্ট পরে জুতো-মোজা সামলে বেরোতে যাব দরজায় ঢকাঢক ধাক্কা। খুলে দেখি লবেঞ্চুসের মা।
“Why my son is saying today is no pants day?”
বুঝলাম লবেঞ্চুসের ঐ ‘ইয়ে-এ-এ-এ’টা ছিল প্যান্টের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়ার উল্লাস। আমি চোখ চালিয়ে দেখি লবেঞ্চুসও ওদের ফ্ল্যাটের দরজা সামান্য খুলে মুচকি হেসে উঁকি দিয়েছে। তারও হরপ্পা-মহেঞ্জেদড়ো কেস। সেটাকেই আমি আত্মরক্ষার ঢাল বানাতে চাইলাম।
“Relax. He is just a kid. Look.” আমি লবেঞ্চুসের দিকে হাত দেখালাম – “You can’t even see his…” এক সেকেন্ড থেমে বললাম – “Dinkus.”
“Dinkus!” লবেঞ্চুসের গলায় আশ্চর্য আনন্দ। সে নতুন একটা শব্দ শিখেছে। পরেরদিন এই শব্দটা তার ডে কেয়ারের আর সবাই শিখে যাবে বুঝলাম। কিন্তু লবেঞ্চুসের মা ছেলের এমন শিক্ষায় আরও তেতে উঠলেন – “I don’t care if you can see his dink… I mean that… thing. Tell him the truth. Tell him there is no such stupid thing like No Pants Day.”
ভদ্রমহিলার গলার ঝাঁঝে পাশের দোতলা বাড়ির ছাদেও আরেক ভদ্রমহিলার আবির্ভাব ঘটল। আমি বিপদ বুঝে লবেঞ্চুসকে কাছে ডাকলাম। তারপর তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বললাম – “Look kiddo, nobody wants to wear pants. But what can we do? It’s the rule. Ok? So please go and put on your pants.” লবেঞ্চুস বিষণ্ণ মুখে চলে যাচ্ছে দেখে মায়া হল, তাই সেদিনের বরাদ্দ লজেন্সটা তার হাতে গুঁজে দিলাম।
উঠে দাঁড়াতেই তার মায়ের মুখোমুখি হলাম। ভদ্রমহিলার মুখ থমথমে লাল – “Nobody wants to wear pants? You know what? You are a bad impression on kids. Don’t ever come near to my son.” আমি অকস্মাৎ এমন দণ্ডাদেশ শুনে বিমূঢ় হয়ে গেলাম। ভদ্রমহিলা দুম-দুম হেঁটে গিয়ে দমাস করে দরজা বন্ধ করার আগে শেষ তিরটা ছুঁড়লেন – “You are a very bad neighbor.”
তারপর চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে। কোনও গোল ছায়া আমার জানালার শার্সিতে এসে পড়েনি এখনও।
3
June 7, 2014
😀 😀 তোমার লেখা যখনই পড়ি জীবনকে একটা নতুন দৃষ্টিকোন থেকে আবিষ্কার করি ! আর শুধু লেখা ! এখানে আমি কার্টুনটা দারুণ উপভোগ করলাম !
June 7, 2014
GREAT
June 7, 2014
দুর্দান্ত রকম ভালো লেখা রোহন। তারাপদ রায় মনে পড়ল।
June 7, 2014
সুতপাদি, কার্টুন আঁকাটা আমার জন্যে অনেক বড় স্বস্তি। 🙂
অরুণাচলদা, এটা অনেক বড় সার্টিফিকেট। শুভেচ্ছা জানবেন।
মুকিম 🙂
June 8, 2014
🙂 :)))
Guns are guarded in pants. No pants, no guns. So all free and peaceful souls should drop their pants. And. for the sake of peace, no pantless should be gunned down. The petition is ready. But will the society bother reading it? Buying the appeal is obviously a far cry… Will any body pay heed? any taker?
June 8, 2014
দারুণ লেখা, রোহণ। খুব মজা পেলাম পড়ে। অমনিস্কোপের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
July 9, 2014
hba vesh valo , Brazil , Germany er khala suru hotey ekhono dare ache tai pora start korechelam , kintu ekhon money hochey portai thake ,khala na hoy pore dhake nabo ….
July 9, 2014
এমন প্রশংসা খুব বেশি পাইনি। যাই হোক, খেলা যা হল… 🙁
July 10, 2014
তাড়ু!
July 11, 2014
রামতাড়ু!