“খবরটা শুনেছ? শিশির স্যর নেই আর।” চ্যাট বক্সে অবিন দুঃসংবাদটা দিল।
গত কয়েকদিন ধরে এত বেশি করে মনে পড়ছিল… শেষ দেখা হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে। মিশন থেকে ফেরার পথে দেখা করে এসেছিলাম। ভাবছিলাম, ইজিপ্ট থেকে কিছু সুগন্ধী নিয়ে যাব। বা কিছু চকোলেট। যদিও জানি ওসবের প্রতি কোনও মোহ তাঁর কখনওই ছিল না। বই পড়তে খুব ভালোবাসতেন। তাই দেখা করতে গেলে বই নিয়ে যেতাম। শেষবার আমার ‘সফোর বাঘ’ দেওয়াতে বিষণ্ণ গলায় বললেন, “দেখতে খুব অসুবিধা হয় এখন। পড়তে পারি না। আলোর দিকে…” ইশারায় বসার ঘরের খোলা জানালার দিকে দেখালেন, “এভাবে ধরে পড়তে হয়।” নিজের হাত দুটো বুকের কাছে প্রার্থনার ভঙ্গিতে মেলে ধরলেন। পড়াশোনা সত্যিই তো উপাসনার মতো ছিল ওঁর কাছে। আর ঈশ্বর বোধ হয় রবিঠাকুর। ক্লাসে বই না দেখে কর্ণকুন্তীসংবাদ আবৃত্তি করে করে পড়াতেন। ওঁর শুনে শুনে আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু লোকহিত! প্রবন্ধও তাঁর কণ্ঠস্থ। এমনকী, কোথায় বিস্ময়চিহ্ন, কোথায় প্রশ্নবোধক চিহ্ন, সেগুলোও বই না দেখেই ব্যাখ্যা করে পড়াতেন। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলতে গিয়ে মনে হত কোন সুদূর থেকে ভেসে আসছে তাঁর কণ্ঠস্বর, সম্মোহিতের মতো। কথিত আছে, মাস্টার্সের ঐচ্ছিক বিষয়ের উত্তরপত্রে তিনঘণ্টা ধরে নাকি শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের নাটকের ওপরই একটা উত্তর লিখে এসেছিলেন। আমরা শুনেছিলাম, সেই উত্তরপত্র নাকি তুলে রাখা হয়েছিল একটি দ্রষ্টব্য হিসাবে। যদিও এসব শোনা কথা। নিজে মুখ ফুটে বলবেন, এমন মানুষ তিনি নন। ফুলহাতা শার্ট কনুই পর্যন্ত গোটানো। আর সাদা ধুতি মালকোঁচা স্টাইলে পরা। চোখে হেমন্তর মতো একটা মোটা ফ্রেমের চশমা। ব্যাকব্রাশ করা চুল। আড়ালে ঠাট্টা করতাম আমরা – স্যার যখন ছোট ছিলেন, খালি গায়ে ছোট ধুতি পরে, কানে চশমা এঁটে হামা দিতেন এ ঘর ও ঘর। এমন নিরাড়ম্বর মানুষটির একমাত্র সোচ্চার অলংকার ছিল তাঁর হস্তাক্ষর। আহা! যেন মুক্তো গেঁথেছে কেউ কাগজের ওপর। এমনকী মুদ্রিত পত্রিকার মুখবন্ধে বিশেষ কোনও লেখা আলাদা করে তুলে ধরতে স্যরকে হাতে লিখতে অনুরোধ করতেন পত্রিকা প্রকাশক।
তাঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয় ক্লাস টেনের মক একজামের ফলাফলের পর। আমাদের ক্লাস নিতেন না। গেস্ট ফ্যাকাল্টি হিসাবে আসতেন। তাই উচ্চ মাধ্যমিকের ক্লাস নেওয়ার সময়টুকুই পেতেন তিনি। তবু কোনও কারণে আমাদের দুটো পেপারই তাঁকেই দেখতে হয়েছিল। বাংলায় আমি বোধ হয় ১৬০-এর কাছাকাছি পেয়েছিলাম। হুমড়ি খেয়ে নোটিসবোর্ডে সবাই মিলে মার্কস দেখছি। হঠাৎ আমাদের অশিক্ষক কর্মী বাবলু এসে ডাকল, “তোমায় শিশির স্যর ডেকেছেন।” টিচার্স রুমে ডাক পড়াটা কখনওই স্বস্তির ব্যাপার নয়, তার ওপর শিশির স্যরের মতো গম্ভীর একজন শিক্ষক। আলাদা একটা চেয়ারে টিচার্স রুমের এক কোণে বসে আছেন। গুটিগুটি গিয়ে দাঁড়ালাম। একগাল হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমিই রোহণ?” আমি ঘাড় নাড়লাম। মুচকি হেসে বললেন, “ভেবেছিলাম আড়ে বহরে আর একটু বড় হবে তুমি।” একথা সেকথার পর বললেন, “একটা বিষয়ে তোমার অনুমতি দরকার।” আমার অনুমতি! “আমি তোমার বাংলা খাতা থেকে প্রবন্ধটা নিতে চাই। আমার মেয়ে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়ে। জীবনানন্দের ওপর একটা প্রবন্ধ লিখে দিতে বলছিল। আমি ভাবলাম, তুমি যেটা লিখেছ, সেটা ওকে দিই।” টিচার-ইন-চার্জের দিকে ইশারা করে বললেন, “ওঁর আপত্তি নেই। কিন্তু তোমার লেখা তো…” আমার মুখের দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত থামলেন। আমার তখন ধ্রাস! ধ্রাস! আমি কোনও রকমে বললাম, “কিন্তু ওটা আমার নিজের লেখা নয়। দু-তিনটে বই মিলিয়ে লিখেছিলাম।” স্যর এবার উঠে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধে হাত রাখলেন, “ওভাবে সংকলন করাও কম কথা নয়। আমি এত বছর শিক্ষকতা করছি, এমন লেখা পরীক্ষার খাতায় কখনও দেখিনি। তোমার আপত্তি থাকলে বলো।” আপত্তি আর কীসের? যে মানুষটার নিজের লেখা প্রবন্ধ নাকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে আলাদা করে সংরক্ষিত থাকে, তিনি নিজে না লিখে পরীক্ষার খাতায় লিখে আসা জীবনানন্দের ওপর আমার লেখাটা মেয়েকে দিতে চাইছেন? আর তার জন্যে আমার অনুমতি চাইছেন!
এরপর ক্লাস ইলেভেন আর টুয়েলভে তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। ক্লাসে পড়াতেন যখন, কীভাবে একটা ঘণ্টা কেটে যেত। ক্লাসের পরেও নানা বিষয়ে আলোচনা হত তাঁর সঙ্গে। বাংলা নাটক থেকে শুরু করে প্যারোডি, দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কোনও কবি সম্মিলনে ওঁর কবিতা পাঠ। মিশনের জুনিয়ারদের থেকে খবর পেতাম, আমি মিশন থেকে চলে আসার পরেও ক্লাসে নাকি প্রায়ই আমার কথা বলতেন। একবার সাক্ষাতে বলেছিলেন, “আজকাল এগারো-বারো ক্লাসের ছেলেরা বিজ্ঞান পড়ে, অঙ্ক করে। কিন্তু তোমার মতো করে বাংলা কেউ পড়ে না আর।” শুনে গর্ব হওয়ার কথা ছিল আমার, কিন্তু স্যরের বেদনাদীর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে দারুণ কষ্ট হয়েছিল।
সহজ নিরহঙ্কার একজন মানুষ চলে গেলেন। আমায় নিঃশর্তে ভালোবাসার মতো একজন মানুষ চলে গেলেন। শেষের কথাগুলো লিখতে গিয়ে চোখ ভরে আসে আচমকা।
29
July 28, 2016
biswas ho66e na……!!! :'( :'(
ami khobor ta tomar lekha thekei jante parlm…amar o chokh e jol ese gelo nijer ojantei…..amrao sir k class ten er test er pore peye6ilm….week e akta class niten….janina oi rokom sir konodin asbe ki na…..!
August 1, 2016
:'(
July 28, 2016
একটাই কথা বলতে চাই……আপনি অসাধারণ লেখেন আর আপনার এই পোস্ট পড়ে চোখটা ভেজা ভেজা লাগছে (যদিও শিশির স্যার কে আমি চিনি না)।
July 29, 2016
:'(
July 30, 2016
শুভেচ্ছা রইল।
July 29, 2016
sotto khub kharap lagchhe shune. Onno class gulo kokhon sesh hobe tai vabtam kintu Sir er class gulo jenno sommohito Kore niten. mone hoto jeno ei elen r ei sesh hoye gelo.
July 30, 2016
একদমই তাই।
July 29, 2016
Loving you sir…until death
July 30, 2016
:'(
August 26, 2016
Eta share korlam fb te….
August 28, 2016
Thank you