আমার ক্ষেত্রে সম্পাদকের তাড়ায় শেষ মুহূর্তের প্যানিক থেকে যা আসে, তা ক্রিয়েটিভিটির নিটোল প্যাকেজ হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তের প্যাকিং থেকে যা আসে, তা এয়ারপোর্টের দাঁড়িপাল্লায় কান ঘেঁষে পনেরো কেজির অতিরিক্ত চার্জ থেকে বেঁচে যায়।
নিওকে দেখতে হায়দ্রাবাদ যাব শুনে লিপি বলল, “আটার সেই পাঁচ কেজির বস্তাটাও নিয়ে যেও। তুমি তো আর রুটি করে খাবে না।” ফলে দুবাইয়ের চকোলেট আর আশীর্বাদ আটার একটা প্যাকেট পাশাপাশি শুয়ে পড়ে আমার ছোট্ট বাক্সটা ভরিয়ে ফেলল। তাতে কোনওরকমে ২-৩টে শার্ট-প্যান্ট, নিও-র জন্যে যৎসামান্য কিছু উপহার ঠুসে দেওয়ার পর পনেরো মিনিট ধস্তাধস্তি করে চেন লাগিয়ে যখন উঠে দাঁড়ালাম, ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা। এরপর আবার রান্না আছে, খাওয়া আছে, রাত তিনটের ক্যাব ধরা আছে। দুটোর সময় বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে একবার পাশ ফিরলাম। ও বাবা, তিনটে বাজে। দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি। কোনওরকমে মুখ-টুখ ধুয়ে এয়ারপোর্ট।
হায়দ্রাবাদে পৌঁছতে সময় লাগল এক ঘণ্টা। লাগেজ-টাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে বেরোতেই এদিকের ড্রাইভারের তাড়া — “সাব, কখন থেকে অপেক্ষা করছি। জলদি আসুন।” আগের রাতের ঢ্যাঁড়স ভাজার লঙ্কাগুলো (আহা! লঙ্কার প্যাকেটটা ফ্রিজে তুলে রাখা হল না। ঝাল-ঝাল ছিল বেশ। এক সপ্তা পরে ফিরে দেখব নষ্ট হয়ে গেছে। :'( ) বেশ জানান দিচ্ছে। ভাবছিলাম, জুস-টুস কিছু খাব। তা এমন তাড়ায় তা আর হল কই। বাপাইয়ের ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেখি ওলা তার কম্মোটি করেছে। বিলের সঙ্গে এয়ারপোর্টের পার্কিং-এর ভাড়াটাও জুড়ে দিয়েছে। ব্যাজার মুখে ভাবলাম, যাক নিও-র সঙ্গে দেখা হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। জানা গেল, সে মহারাজ ব্রেকফাস্ট শুরু করেছেন সবে। ওদিকে অফিসের জন্যে তৈরি হতে হবে। কোনও রকমে তৈরি হয়ে নিওকে এক ঝলক দেখে নিয়ে তাড়াহুড়োয় বেরিয়ে দেখি, জ্যামের যা বহর, তাতে অফিসে পৌঁছতে পৌঁছতে নিও বেশ বড় হয়ে যাবে।
বিরক্তিকর একটা বাসযাত্রার শেষে অফিসে পৌঁছে শুনে ক্লায়েন্ট কীসব সিকিউরিটি ইস্যু নিয়ে এসক্যালেটে করেছে। তা ব্রেকফাস্ট সেই এসক্যালেশান দিয়েই সারলাম। চার ঘণ্টার ম্যারাথন কল শেষে ফুড কোর্টে গিয়ে দেখি সাড়ে তিনটে বাজে। যা রয়েছে, তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল, ভেজ হটডগ আর চিলি পনির হটডগ। হে মাওলা, এই দিন দেখাতে তুমি আমায় হায়দ্রাবাদ আনলে? বিরিয়ানির বৃন্দাবনে এসে ভেজ হটডগ! একটা বাচ্চা ছেলে বসে দোকান সামলাচ্ছিল। তাকে ডেকে রঞ্জিত মল্লিক স্টাইলে বললাম, “আপনাদের লজ্জা করে না, গরিব সফোদের পয়সার বদলে এমন অখাদ্য বিক্রি করছেন?” সে বেচারা কিছু বলতে হাঁ করেছিল, ধমক দিলাম — “এই কুকীর্তির শেষ দেখে ছাড়ব। এইচ আর কমপ্লেন করব।” পাশ থেকে এক ছোকরা মিহি গলায় ডাকল, “মাটন রোল আছে। চলবে?” দয়া করে দুটো মাটন রোল আর এক প্লেট মোমো নিয়ে সে যাত্রায় ওদের ক্ষমা করে দিলাম। মাটন রোলে আবার বিনি পয়সায় এক্সট্রা চিজও দিয়ে দিল।
তারপর আবার ক্লায়েন্ট কল, ইন্টারনাল কল, ঝাড়পিট, এ্যাকশান সিকোয়েন্স, মেলোড্রামা, ম্যানেজারের কুম্ভীরাশ্রু। রাত সাড়ে আটটায় মনে হল বাড়ি ফেরা উচিত। এদিকে পেট খিদেয় চুঁইচুঁই করছে। ভেন্ডিং মেশিন থেকে একটা চিকি কিনতে গিয়ে নিমোর কথা মনে পড়ে গেল। ছেলেটা ‘শুধু বাদাম’ খুব ভালোবাসে। প্যাকেটটা আর না কেটে ব্যাগে ভরে গেটের দিকে রওনা দিলাম। ল্যাপটপ ব্যাগ চেক করা হয় বেরনোর আগে। সেখানে দেখা হল ছোটেলালের সঙ্গে।
সে একগাল হেসে বলল, “আরে রোহণবাবু আপ ইঁহা!” আমি প্রত্যুত্তরে বললাম, “ট্যাগ দেখে নাম বলছ, নাকি সত্যিই মনে আছে?”
বছর তিনেক আগে একবার হায়দ্রাবাদ ক্যাম্পাসে এসে সপ্তা ছয়েক ছিলাম। আমি তখন কোম্পানির গেস্ট হাউসে থাকতাম। ক্যাম্পাসের মধ্যে পার্সোনাল ল্যাপটপ নিয়ে ঢোকা নিষেধ ছিল বলে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় জমা রাখতে হত। কিন্তু আমার যাবতীয় লেখাপত্র, অফিসের বাইরের কাজকর্ম সব ওই ল্যাপটপে ছিল। তাই দিনের শেষে আমি সিকিউরিটির দেখিয়ে দেওয়া সেই নির্দিষ্ট জায়গায় বসে কাজ করতাম। ছোটেলাল ওই ঘরটি পাহারা দিত। আমায় রোজ ল্যাপটপ বের করে দিত আর আমি রাত দেড়টা-দুটোয় তাকে যন্তরটা ফেরত দিলে সে তুলে রাখত। সেই কথা মনে করিয়ে দিয়ে সে বলল, “আপনার জন্যে দুটো-আড়াইটা পর্যন্ত জাগতে হত। ভুলি কী করে?” আমি মৃদু হেসে বললাম, “তার মানে অনেক গালাগালিই করেছ।” ছোটেলাল নিজের ডান কানের লতি ছুঁয়ে বলল, “ও কথা বলবেন না দাদা। আপনি চলে যাওয়ার পর অত রাতে আর কেউ আসত না। প্রথম কদিন ঘুম আসেনি।” কথাটার শেষ দিকে একটু বিষণ্ণ হয়ে উঠল তার গলা। আশ্চর্য হলাম। ক্যাম্পাসের হাজার পনেরো চাকুরের ভিড়ে একজন সিকিউরিটি গার্ড আমায় মিস করেছে? ছোটেলাল আবার গলা তুলল, “তা আপনার পার্সোনাল ল্যাপটপটা কই? এবার আর আমার জিম্মায় দেবেন না?” আমি বদমায়েশি করে বললাম, “বেচে দিয়েছি। পয়সার দরকার ছিল।” ছোটেলালের মুখ আবার বিষাদময় — “লাস্ট মে মাসে বাবুজির চিকিৎসার জন্যে আমাদের গাই দুটোকে বেচে দিতে হল। ইয়ে প্যয়সা বঢ়াহি কুত্তি চিজ হ্যায়।” আমার ল্যাপটপ বেচাটা নেহাতই মজা করে বলা, কিন্তু ছোটেলালের গাই বেচে দেওয়ার দুঃখ স্পর্শ করল। মনে পড়ে গেল, কুরবানির ঈদের আগে গ্রামের নিম্নবিত্ত চাষী তার গরুর দড়িটা নারকেল গাছের গায়ে বেঁধে দিয়ে কীভাবে চোখ মুছতে মুছতে চলে যায়। গরুটা সমানে তার ভূতপূর্ব মালিককে ডেকে চলে।
ওদিকে বাপির ফোন আসছে ঘনঘন। সারাদিন কথা হয়নি। এগোতে হবে। শেষ মূহুর্তে চোখে পড়ল তার বুকের দিকে — নামের ধাতব ট্যাগে ঝকঝক করছে ‘এম এল মিশ্র’। সেদিকে ইশারা করে জিজ্ঞাসা করলাম, “ছোটেলাল, তোমার আসল নাম কী? এতদিন দেখা হয়েছে, জানা হয়নি।”
সে একগাল হেসে বলল, “মুঙ্গেরিলাল। টিভিতে এই নামে একটা সিরিয়াল আসত ছোটবেলায়। আমার বাবুজির খুব পছন্দের ছিল। ইস্কুলে ভর্তির সময় তাই নাম লিখিয়েছিল মুঙ্গেরিলাল।”
আমি হা হা করে হেসে ফেললাম — “সেই গানটা মনে আছে তোমার? সিরিয়ালটার শুরুতে যেটা হত?” ছোটেলাল উর্ফ মুঙ্গেরিলালের মোটেও মনে নেই। আমি তখন হুঁ-হুঁ সঙ্গীতে শোনালাম, “মুঙ্গেরিলাল কে হাসিন স্বপনে… হুঁ হুঁ হুঁ, স্বপনে মে আপনে…” তারপর খুঁজে পেতে ইউটিউবে চালিয়ে দিলাম। আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা আর দুজন সিকিউরিটি গার্ড এগিয়ে এসেছে ততক্ষণে। পুরো একটা ক্লান্তিকর দিনের শেষে আমরা চার সমবয়সি অসম-বন্ধু শুনছি — “স্বপনো কি নাম নেহি, স্বপনো কি দাম নেহি, স্বপনো কি ঘোড়ে পর কিসিকে লাগাম নেহি…”
ওমনিস্কোপ
Homepage of Rohon Kuddus
August 28, 2016
amr apner lakha porte khub valo laga sir….ami akn no sai misson ar math exm noa ta miss kori,….
jokhon mar khaor voi hoto mona tokhon sudhu jigas kora kobe jabe sir jodi 2-3 din baki thaka tahole jotoi boluk sir marba na….ar valo exm hola khokon pen gift dabe sai asai thaktam…..
washim parvez
barasat
August 28, 2016
থ্যাংকিউ ওয়াসিম। আমি পেন গিফট দিতাম সেটা কেউ বলেই না। সবাই মারের কথাটাই বলে। আমিই ভুলে গিয়েছিলাম। 🙂
আমিও তোমাদের খুব মিস করি। এখনও।
August 28, 2016
Ai gulo jiboner onnotomo prapti…
Khub valo laglo..
August 28, 2016
ঠিকই, এই ছোট ছোট প্রাপ্তিগুলো নিয়েই এগিয়ে যাওয়া।
December 10, 2016
আহা , বড় ভালো লাগল… আরও অনেক অনেক লেখা আর টুকরো লেখায় ভরে উঠুক তোমার ল্যাপি 🙂
February 11, 2017
থ্যাংকু, থ্যাংকু 🙂