প্রতিবার ঈদের সকালে পাজামা-পাঞ্জাবি আর মাথায় টুপি দিয়ে বের হলে নতুন প্রতিবেশীরা একটু ভড়কে যায়। বিশেষ করে পাশের ফ্ল্যাট। গতবছর ঈদের পর নতুন পরিবার এসেছে। সকাল-সকাল আমায় এমন চেহারায় দেখে অপ্রতিভ হেসে বলল, “জানতামই না তুমি…” আমার মাথার দিকে তাক করল। আমিও মুচকি হেসে সিঁড়ি ধরলাম, বছরে এই এক-দুবারই জানা যায়। আর তাছাড়া আগে জানিয়েও লাভ কী হত, হর জুম্মায় থোড়ি না বিরিয়ানি খাওয়াত। যাকগে, রাস্তায় নেমে হাঁটাই স্থির করলাম। ব্যাঙ্গালোরের অটোওয়ালারা এমনিতে গলাকাটা। এদের মিটারটা বোধ হয় টাইম ট্রাভেলের ক্যালিব্রেশানের জন্যে ব্যবহার করে। আজ পর্যন্ত চোখে পড়ল না নিরামিষ রোড ট্রাভেলে কেউ ভাড়া গোনার কাজে ব্যবহার করছে। গন্তব্য জেনে নিয়ে মর্জিমাফিক একটা দর হাঁকে। তার ওপর জানে, ঈদের দিন মোল্লাকে মসজিদে যেতেই হবে, তাই আজকের জন্যে মাশুলও হবে জবরদস্ত। মিনিট পাঁচেক হেঁটেছি কি হাঁটিনি, পেছন থেকে এক বাইক সওয়ার হাঁক দিল, “ঈদগাহ যাচ্ছ তো?” যাচ্ছি আসলে মসজিদে, কাছেই। বললাম। বলল, “উঠে এসো।” চালক আর তার সাথির দিকে নজর চালিয়ে বললাম, “তিনজন চড়া ঠিক হবে না। মামারা কেউ দেখে ফেললে ফালতু ঝামেলা হবে।” চালক বু-হা-হা-হা টাইপ হেসে জানাল, আজ কোনও হাবিলদারের চোদ্দো পুরুষের হিম্মত নেই তিন টোপিওয়ালাকে পাকড়াও করে। তাও বটে। ঈদের দিন বলে কথা। গণতান্ত্রিক ধর্মিনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রজাতন্ত্র বাইকে আসীন এই রত্নদুটির মতোই বটে। অন্য কোনও দিন এই রাস্তার ধারে যদি দেবদাসের মতো ধুতি-পাঞ্জাবি-উসকো-খুসকো-চুল-মোমঘষা-ফাটা-ঠোঁট হয়ে পড়ে থাকতাম, এক ফোঁটা জলও এগিয়ে দিতে থামত না এরা। কিন্তু বিশেষ বিশেষ এই দিনগুলোতে বেরাদারির প্রতি দরদ উথলে ওঠে এদের। মরুক গে, উঠেই পড়লাম। ও মা! দু মিনিট পরেই দেখি অন্য রাস্তা নিয়েছে। আমি বলার চেষ্টা করলাম, মসজিদ ওই দিকে। তারা বলে, ময়দান ওই দিকে। সেখানে বড় জমায়েত হয়। আর তাছাড়া, নামাজ যে কোনও জায়গায় পড়লেই হল। কবুল হওয়া নিয়ে কথা। এই দার্শনিকদের কী করে বোঝাই যে, আসলে ওই ময়দানটি আমার বিশেষ পছন্দের নয়। বাবার কিনে দেওয়া সাধের জুতোজোড়া মাড়িয়ে নোংরা করে দেয় লোকজন। তার ওপর আজকাল কখন যে বৃষ্টি হয় তার ঠিক নেই। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে সেই ময়দানে এসেই হাজির হতে হল।
সকাল দশটায় নামাজ হওয়ার কথা। ঘড়িতে নটা পনেরো। জুতোটা একটা আপাত নিরাপদ জায়গায় খুলে বিছিয়ে রাখা বারোয়ারি জায়নামাজের ওপর আসীন হলাম। মাইকে কে একজন ঈদের নামাজ পড়ার আগে কী কী করণীয় সেসব শোনাচ্ছেন। জানা গেল, ফিতরার টাকা এঁদের দেওয়া যেতে পারে। মাঠের একদিকে দাঁড়িয়ে দু-তিনজন টাকা নিয়ে গোলাপি রসিদ দিচ্ছেন। কে যেন বলেছিলেন, দান এমনভাবে হওয়া উচিত, যাতে ডান হাতে দান করলে বাঁ হাত টের না পায়? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশেপাশের জনতার দিকে মন দিলাম। সময়ের অনেকটা আগে আসার মুখ্য কারণ এটাই। বিচিত্র সব মানুষ দেখা যায়।
এক ছোকরার তালুতে দেখলাম, মেহেন্দি দিয়ে মোটা করে ডলার আঁকা। সে ব্যাটা উঠে দাঁড়িয়ে একটা গাবদা মোবাইলে ভিডিও ক্যাপচার করছে। কিছুক্ষণ পর নজরে এল তার অন্য তালুতে একই রকম করে পাউন্ড আঁকা আছে। নিশ্চিত আদনান শামির কেউ হয়। হঠাৎ খেয়াল করলাম বাঁ পাশের লোকটি ভাঙা ভাঙা কন্নড়ে তার বাঁ পাশের লোকটির সঙ্গে বাক্যালাপ চালাচ্ছে। হিন্দি শুনেই যেমন অধিকাংশ ক্ষেত্রে বোঝা যায় লোকটা বাঙালি ছাড়া কিছু হতে পারে না, তেমনটা যে কন্নড়ের ক্ষেত্রেও হয় আগে জানতাম না। বুক ঠুকে বলেই দিলাম, “পারেন না যখন কন্নড় বলছেন কেন? এরা হিন্দি বোঝে তো।” লোকটা কাঁচুমাচু উত্তর দিল, “হিন্দি একেবারেই বলতে পারি না দাদা। তাই কন্নড় শিখে নিয়েছি।” সাবাস বাঙালি! রুটি নেই, তাই কেক খাচ্ছে। জানা গেল তার নাম রফিক মিঞা। বাড়ি বাংলাদেশ। রাজশাহী। বাংলা শুনে অবশ্য বড়জোর মুর্শিদাবাদের লোক মনে হয়। আলগোছে জিজ্ঞাসা করলাম, “রাজমিস্ত্রির কাজ করেন নাকি?” রফিক মিঞা ঘাড় নেড়ে বলল, “অটো চালাই।” সে বছর চারেক আগে এদেশে হার্টের চিকিৎসা করাতে এসেছিল। কিন্তু রোগ সারার আগেই তার টাকা ফুরিয়ে যায়। তারপর সে একটা অটো কিনে ইলেকট্রনিক সিটিতে অটো চালায়। টাকা ফুরোল তো, অটো কিনল কোত্থেকে? আসলে সঙ্গে বাবা আর মামা ছিল, তারা দেশে ফিরে জমি বেচে টাকা পাঠিয়েছে। এই এলাকারই একটা ড্রাইভিং স্কুল থেকে অটো চালানো শিখেছে। আর তার ভিসা? এ্যাদ্দিন আছে যে? উত্তর দেওয়ার বদলে হঠাৎ রফিক মিঞা প্রশ্ন করল, “লোকটা কী বলছে বলেন তো?” লোকটা বলতে, সেই লোকাল আর্টিস্ট। বড় শিল্পী আসার আগে মঞ্চ আগলে রাখে, লোক টানে। কিছুক্ষণ আগেও ঈদের নামাজ নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছিলেন। এখন বারবার বলছেন, দ্বিতীয় আর তৃতীয় সারিতে জায়গা ফাঁকা আছে, জনগণ যেন শূন্যস্থান পূরণ করেন। হিন্দি থেকে বাংলা করে বললাম রফিক মিঞাকে। সে চার হাত পায়ে খাড়া – “চলেন, ওখানে গিয়ে বসি।” আমি বরাবর প্রথম দিকের বেঞ্চগুলোতে বসার বিরোধিতা করে এসেছি। তাই নৈতিক দায়িত্বে ঘাড় নাড়লাম। রফিক মিঞাও অনড়, যাবেই। কারণ প্রথম দিকের সারিতে বসলে বেশি পুণ্য। ও হরি! তাই সবাই দ্বিতীয়-তৃতীয় সারি ছেড়ে প্রথম কাতারে গিয়ে জমেছে! আমার পাপী মন, ভাবছিলাম প্রথম সারিতে গাছের ছায়ার লোভে ওরা গিয়ে বসেছে। যাই হোক, নেকির লোভ এড়ানো দায়। রফিক মিঞা চলে গেল। আমি এবার ডান পাশের জনকে নিয়ে পড়লাম। সে বিহার থেকে, রাজমিস্ত্রির কাজ করে। আর তার পাশের জন উত্তরপ্রদেশের। ফুচকা বেচে।
দশটা বাজতে চলল। নামাজ শুরু হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। হঠাৎ শুনলাম, মাইকে ঘোষণা হচ্ছে মদিনা মসজিদের ইমাম সাহেব এসে হাজির হয়েছেন। তিনি এবার জনগণের উদ্দেশ্যে দু-চার কথা বলবেন। বুঝলাম আসল শিল্পী এসে হাজির হয়েছেন। ইমাম সাহেব শুরু করলেন, “এই সময় পৃথিবীতে যা চলছে…” খুব আশান্বিত হয়ে কান খাড়া করলাম। বর্তমান পৃথিবীতে চলতে থাকা ইসলামিক জঙ্গিদের বাঁদরামি নিয়ে জনগণকে সতর্ক হতে বলবেন নিশ্চয়। ভাবলাম, প্ররোচনায় পা না দিয়ে সব ধর্মের মানুষের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ বসবাসের কথা বলবেন ইনি। কিন্তু আমার সমস্ত আশায় জল ঢেলে উনি ফেসবুক আর ট্যুইটারের শ্রাদ্ধ শুরু করলেন। গেরামভারি স্বরে খোলসা করতে লাগলেন, কীভাবে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের মাধ্যমে আমরা জাহান্নমের দিকে এক পা বাড়িয়ে আছি। এখন বুঝতে পারছি না, মরলেই টের পাব। সব শালাই এক। আমি সব ছেড়েছুড়ে আকাশ দেখতে শুরু করলাম। রোদের তাপ আর নেই। মেঘ জমতে শুরু করেছে। হালকা হাওয়াও দিচ্ছে। বেশ আরাম লাগছে। মনে হচ্ছিল, প্যাচপ্যাচে গরমে বসে এইসব ষাঁড়ের গোবর শোনাটাকে বান্দার জন্যে সহনীয় করে তুলতে সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে দিলেন। আহ! বেশ ঘুম-ঘুম পাচ্ছে।
হঠাৎ কানে এল, নবীজী কীভাবে এক এতিম ছেলেকে ঈদের দিনে রাস্তা থেকে তুলে বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। ফাতিমা তাকে স্নান করিয়ে নতুন জামাকাপড় পরিয়ে দিচ্ছেন। আর নবীজী অপেক্ষা করছেন কখন তাকে নিয়ে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন। ঈদগাহে মানুষ অপেক্ষা করছেন নবীর জন্যে, আর নবী দরজায় অপেক্ষা করছেন এক বাপ-মা হারা ছেলের জন্যে। বহুবার শোনা এই গল্পটির শেষে ওই একটা সহজ সুন্দর বাক্য ঈদের সকালটা উজ্জ্বল করে তুলল।
এবার নামাজের পালা। ছয় তকবিরে কখন তহরিমা বাঁধতে হয়, কখন ছাড়তে হয় আর কখন রুকুতে যেতে হয় – এই নিয়ে চার্লি চ্যাপলিন একটা ছবি বানালে পারতেন। খোদার কসম, প্রত্যক্ষদর্শীরা জানেন, ব্যাপারটা দারুণ মজাদার হয়। নামাজ শেষে কোলাকুলি। খেয়াল করে দেখলাম, রফিক মিঞা এদিকেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে আসছেন। মুখটা গম্ভীর রেখে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী মিঞা! নেকির ভারে চলতে পারছেন না যে।” জানা গেল, দ্বিতীয় নয়, সে গিয়েছিল একেবারে প্রথম সারিতে। সেই গাছের তলায়। বেশ মোটা মোটা পিপড়ে ছিল। তারই একটা ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের পাশে বেশ ভালো রকম কামড় দিয়েছে। পুণ্যের কোল্যাটারাল ড্যামেজ। কোলাকুলির জন্যে হাত বাড়ালাম। একটু ইতস্তত করে রফিক মিঞা হাত মেলানোর জন্যে দু হাত বাড়াল। হাত দুটো ধরে তাকে বুকে টেনে নিয়ে মনে মনে বললাম, ঈদগাহে অন্তত এই অভিনয়টা করতে দাও মিঞা। বাইরে গিয়ে আবার আমি বড় কোম্পানির আইডি ঝোলানো সফো। তুমি আবার গলাকাটা অটো ড্রাইভার। তুমি সামনে বসে দিনরাত রাস্তায় নজর রাখবে। আমি পেছনে বসে পায়ের ওপর পা তুলে ব্যস্ত মুখে ফেসবুক করব। অন্তত এই একটা দিন ওপর থেকে যিনি নজর রাখেন, কোনওভাবেই যাঁকে ফাঁকি দেওয়া যায় না, তাঁকে ভাবতে দাও ভাই বলে তোমায় বুকে জড়িয়ে ধরেছি।
20
July 9, 2016
Golpo tir sharmormo amar chhotto gyan e khub ekta porishkar holo na!!
Ami tomake Dada Al Ameen Mission thekei chini. Rohon Kuddus_ ey naamta amader junior der kachhe – protibha, bhodrota, ar porishromer ek adbhut mishron (Nurul Islam secretary Sir er kotha shune etay jenechhi). Jay hok…
Tobe amar kichhu birodhita royechhe ey lekha ti niye.
1) prothom ongshe tumi amader adhunik deshbhusha k prochhono bhabe somorthon janale. Amra amader kajer Sarthe onno der shonge nijeder miliye niyechhi. Onner songskriti Ke amra horofe horofe Mene choli. Amar Protibeshi Jodi jaante na pare_ je Ami Muslim, seta amar barthota. Ekjon Muslim sei, jar posak, jar gotibidhi somosto kichhui bole debe she ekjon Muslim. Ekjon Sikh Jodi taar paagri niye, Dari niye prithibir samney matha unchu kore banchte paare_ tahole amra keno noy?? Protibeshir….” jantam e na tumi…” ey chhotto kothati amar somprodaayer barthota key tule dhure. Lukiye theke amra shafollo kokhonoy pabona.
2) Eid gaaher Maulana tike keno dosh debo?? Dhormo niropekhkhotar buli awrano ki sudhu taanr e kortobbo? Aapato dhormoniropekhkhor dhojadhari ra madhur bayaan diyei cholechhen_ asha rakhi she somporke tumi obogoto achho.
3) Kew amay bolechhilen_ ” tumi Unader sathe eksoto sotangsho mishe Gelew, Onra tomay kokhonoy apon kore neyna.” Byaktigoto jibon e taar udahoron er obhab nei….
Onek kothay bola Jay Rohon Dada. Somoshey amaderi, amray amader songskriti, deeni sikhkha theke onek dure_ taay amader Kew shomman korena. Ami joto tuko jaani Islam e kono ” punno pawar ojachito lodai nei”_ ” kono obhinoy ar bhondamir shompriti nei”
Bhul amader_ amray Islam k bujhini.
Chhotto mukhe boro boro comments korchhi_ taay obosheshe KHOMAPRARTHI
July 9, 2016
মুস্তাফিজুর, আমি যেমন দেখি, তেমন লিখি। কোনও নীতি, ধর্ম বা যে কোনও আদর্শের প্রতি আমার কোনও বিরোধিতা নেই। তাই কাউকে মহান দেখানোর দায়ও আমার নেই। নিজেকে মুসলমান বানিয়ে তোলার আগে সাধারণ মানুষ ভাবতে শেখাটা অনেক জরুরি। আমার জ্ঞানমতে ইসলামের মূল শিক্ষাও তাই-ই।
July 10, 2016
tumi to moha fokkor chhele! tomar aar rastrer dewa puraskar jutlo na… oi hearte=er byaram aar visa na ja bolle.. tar jerei omon siddahnato kollum… aar neki korle je nyaka sajte hoi tamon dabi dawa-r jonyo tomar jannat-o jutbe bole mone hoi na… e bisoye amar kono gyan nei… tai sondeho prokash korlam matro .. kno nidan hanklam na
. iye lomba bhyortsona-ta porlam na… onyo kichhu na korte ichchhe korle oporichoto bhyortsok-ke ekhaat niye jabo…
even then Eid Mubaraq….
July 13, 2016
আমার কিছু হওয়ার নেই।