আমি বসেছি জানালায়। আমার পাশে মিষ্টু। তার পাশে আইলে মিষ্টুর মা। ব্যাঙ্গালোর থেকে কলকাতা। যদ্দূর মনে পড়ছে সকাল সাড়ে আটটার ফ্লাইট। মিষ্টুর মা বোধ হয় মেয়ের সঙ্গে সারাদিন-রাত ধস্তাধস্তি করেন, কারণ দৃশ্যতই তিনি ক্লান্ত ছিলেন এবং টেক-অফের পরেই ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি মিষ্টুর দিকে মনোযোগ দিলাম। টেনেটুনে বছর আটেক হবে বোধ হয়। জিজ্ঞাসা করলাম — “কোন ক্লাসে পড়ো?” আমার দিকে একবার তাকিয়ে সে পালটা প্রশ্ন করল — “তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?” লিপি মাঝে মাঝেই বলে আমায় কলেজ স্টুডেন্ট (বা ওর ছোট ভাই) হিসাবে এখনও চালিয়ে দেওয়া যায়, তাই বললাম — “আমি কলেজে পড়ি।” মিষ্টু উৎসাহ পেয়ে চোখ বড় বড় করে বলল — “আমার সোনামামাও কলেজে পড়ে। ব্যাঙ্গালোরেই থাকে। আমাদের সঙ্গে।” তারপর জিভ কেটে চুপ করে গেল। আমি খোঁচালাম — “কী হল?” মিষ্টু করুণ মুখে একবার তার ঘুমন্ত মায়ের দিকে দেখল। তারপর আমার দিকে একটু সরে এসে ফিসফিস করে বলল — “বাড়ির কথা মা বাইরের লোককে বলতে বারণ করেছে।” আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম — “ঠিক আছে। তুমি বরং তোমার স্কুলের কথা বলো।” মিষ্টু শোনাতে আরম্ভ করল কোন স্কুলে পড়ে, কী কী সাবজেক্ট ইত্যাদি। এর মধ্যে খাওয়াদাওয়া শুরু হয়েছে। আমার ব্রেকফাস্ট অর্ডার দেওয়াই ছিল। মিষ্টুকে তার থেকে ফ্রুট জুস দিতে গেলাম, সে নিল না। বুঝলাম তার মায়ের বারণ। তাই বাধ্য হয়েই তার মাকে ডেকে জাগাতে হল। একটা বাচ্চা মেয়ে পাশে বসে দেখবে আর আমি মজাসে চিকেন স্যান্ডউইচ সাঁটাব — এমনটা এই বয়সে এসেও ঠিক ধাতস্থ হয়নি। তার মা বিরক্ত মুখে ‘না’ বলে আবার হাঁ করে মৃদু স্বরে নাক ডাকতে শুরু করলেন। আমি পড়লাম আতান্তরে। খিদেও পেয়েছে। তাই শেষ চেষ্টা করলাম — “এটা তো এয়ারলাইন্সের সিলড প্যাকেট। আমি চেষ্টা করলেও এতে ঘুমের ওষুধ মেশাতে পারব না।” মিষ্টু আমার দিকে হাঁ করে তাকাল কয়েক সেকেন্ড। তারপর বড় বড় চোখ করে জিজ্ঞাসা করল — “ঘুমের ওষুধ! আমি তো ভাবতাম স্ট্রেঞ্জার আঙ্কলরা টফিতে বিষ মেশায় বলে মা নিতে বারণ করে।” এবার আমার অবাক হওয়ার পালা — “বিষ কেন মেশাবে?” যাই হোক, শেষমেশ আমি স্যান্ডউইচ খেলাম আর মিষ্টু তার মায়ের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে জুস শেষ করল। কথায় কথায় ট্রপিকানা জুসের প্যাকেটের গায়ে লেখা ওয়েবসাইট ইউ আর এল চোখে পড়ল। সেই ওয়েবসাইটে কী কী থাকতে পারে এই নিয়ে আলোচনা হল একটু। ওয়েবসাইট থ্রিডি হলে তার সুবিধা সম্পর্কে মিষ্টু বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিল। আমিও একমত হলাম — থ্রিডি ওয়েবসাইট থেকে জুসের প্যাকেট সহজেই নিয়ে টেস্ট করা যেত। এরপরই ইন্টারনেট এবং সেই সংক্রান্ত সুরক্ষাবিধি সম্পর্কে মিষ্টু আমায় সতর্ক করল। অনেকেই মেল আইডি হ্যাক করার চেষ্টা করে থাকে। এ বিষয়ে তাদের স্কুলেও কীসব নাকি কোর্স হয়েছে। মিষ্টু একহাত লম্বা একটা মেল আইডি বলে গেল। স্কুল থেকেই বানিয়ে দিয়েছে। আমাকেও আমার মেল আইডি দিতে হল। আমি স্যান্ডুইচের প্যাকেটের একটা কোণ ছিঁড়ে লিখে দিলাম। সেটা তার পাশে রাখা ছোট একটা ব্যাগে পাচার করল।
খাওয়ার পর আমার সামান্য ঝিমুনি এসেছিল। হঠাৎ বড়সড় ঝাঁকুনিতে তন্দ্রাটা কেটে গেল। চোখ খুলে বুঝলাম প্লেনটা এয়ার পকেটে পড়েছিল। মিষ্টু দেখলাম বেশ ভয় পেয়েছে। আমায় চোখ খুলতে দেখে জিজ্ঞাসা করল — “প্লেনটা কি ক্র্যাশ করবে?” আমি মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বললাম — “ধুর একটা রামধনু, মানে ইয়ে রেনবোর সঙ্গে ধাক্কা লেগেছে বোধ হয়। এমন কিছু নয়।” মিষ্টু সন্দিহান গলায় জিজ্ঞাসা করল — “প্লেনের সঙ্গে রেনবোর ধাক্কা লাগলে কিছু হয় না? যদি প্লেনের ডানা ভেঙে যায়?” সূর্যের আলো সরাসরি আসছিল বলে জানালা বন্ধ রেখেছিলাম। এবার খুলে দেখালাম। প্লেনটার ডানা অক্ষত আছে দেখে মিষ্টু সামান্য আশ্বস্ত হল। তবুও আবারও বলল — “একেবারেই কিছু হয় না?” আমি প্রশ্ন করলাম — “একেবারেই কিছু হয় না, তা নয়। VIBGYOR-এ কী কী রঙ আছে বলো তো?” সে গড়গড় করে বলে চলল। আমি এবার জিজ্ঞাসা করলাম — “আমরা কোন ফ্লাইটে আছি?” মিষ্টু নামটা বলেই ভুরু কোঁচকাল — “তাতে কী হল?” আমি সিধু জ্যাঠা স্টাইলে জ্ঞান দিলাম — “আগে এই এয়ারলাইন্সের নাম ছিল গরুড়বাহন। একবার রেনবোতে ধাক্কা খাওয়ার পর ইন্ডিগো রঙ লেগে গিয়েছিল প্লেনটার সারা গায়ে। সেই থেকে এয়ারলাইন্স কোম্পানি নাম পালটে নিয়েছে।”
ততক্ষণে কলকাতায় নামার ঘোষণা হয়ে গেছে। মিষ্টুর মা-ও কখন ঘুম থেকে উঠে আমার ব্যাখ্যা শুনছিলেন জানি না। তিনি বিরক্ত মুখে বললেন — “বাচ্চাদের এসব আজেবাজে জিনিস শেখাচ্ছেন কেন?” মিষ্টু বাকিটা সময় বেশ চিন্তামগ্ন ছিল দেখলাম। হয়তো আমার যুক্তিগুলো মনে ধরেছিল। কিন্তু মায়ের কথাটাও ফেলতে পারছে না।
সেটা ছিল মে মাসের গল্প। বাড়ি ফিরে লিপিকে মিষ্টুর কথা বলেছিলাম। স্বভাবতই অচেনা বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলতে সেও মিষ্টুর মায়ের মতোই আমায় নিষেধ করে দিয়েছিল। তারপর যথারীতি মিষ্টুর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু আজ সকালে দেখলাম একটা অচেনা মেল আইডি থেকে মেল এসেছে —
Dear Uncle,
Now I have learnt to search Google. I could not find any link about aeroplane bumping rainbow. Please send me that. Hope you are fine.
Mishtu
9
August 1, 2016
Khubi juktipurno explanation. I agree!
August 1, 2016
যাক। কেউ তো বুঝল। 🙂