সে ছিল এক রবিবার। সকাল সকাল উঠে হি-ম্যান দেখার কথা। কিন্তু চোখ খুলে দেখি মা তখনও বিছানায়। বাপি বাইরে বারান্দায় অস্থির পায়চারি করছে। পরিস্থিতি সুবিধের নয় দেখে বাপিকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, মায়ের শরীর ভালো নয়। আজ টিভি চালানো যাবে না। কিন্তু তারপর বাপি যোগ করল, কিছুক্ষণ পরেই আমরা কলকাতা যাব। একটা গাড়ি আসছে, যেন তৈরি হয় নিই। তারপর একটা সাদা এ্যাম্বাসাডার চড়ে বাগনান থেকে বোম্বে রোড ধরে আমরা গিয়ে হাজির হলাম কলকাতায়। মা ভর্তি হল পার্ক সার্কাসের একটা নার্সিংহোমে। আমায় বাপি রেখে এল মামণির (আমার এক পিসি) কাছে। তারপর সেদিন বেশ বেলায় খবর পাওয়া গেল আমার এক ভাই হয়েছে। সন্ধেবেলায় ভিজিটিং আওয়ার্সে রাঙাকাকু, আমি আর টিটু গিয়ে হাজির হলাম ভাইকে দেখতে। জানা গেল, এই একই নার্সিংহোমে আমিও হয়েছিলাম। যাই হোক, মায়ের বিছানার একপাশে দেখি গায়ে সাদা সাদা ছালওঠা গোলাপি রঙের একটা পুঁটলি শুয়ে আছে। খুব সত্যি বলতে কী, এর আগে অত ছোট বাচ্চা আমি দেখিনি। তাই বারবার মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ভাই ঠিক আছে কিনা।
পরে তার নাম আমার ডাকনামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হল বাপাই। আরও পরে তার একটা ভালোনামও ঠিক হল। মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল রোহণের ভাই রাহুল হোক (পরে করণ জোহর এই আইডিয়াটা ঝেড়ে দিয়েছিলেন কে থ্রি জি-তে), কিন্তু রাহুল বুদ্ধদেবের ছেলের নাম এবং রাজীব গান্ধীর ছেলের নাম — এমন অজুহাতে ভেটো দিলেন আমাদের পরিবারের কিছু ধার্মিক মানুষজন। শেষমেশ তার নাম রাখা হল রাকিব, মানে দায়িত্ববান। মুসলমানের ছেলের আরবি নামও হল, সে নামের মানেও ভালো হল। সবাই-ই মোটামুটি খুশি হয়েছিল। আমি ছাড়া। তখন ব্যাপারটা নিয়ে দারুণ রাগ হলেও, এখন রাহুল গান্ধীকে দেখে মনে হয়, যা হয়েছিল ভালোর জন্যেই হয়েছিল।
যাকগে, তারপর সেই ছেলে বড় হল। আমায় দাদা না বলে নিজে থেকেই ‘দাদান’ বলে ডাকতে আরম্ভ করল। ইস্কুলে ভর্তির বয়স হতে দেখা গেল, আমি যে স্কুলে পড়ি সেখানে আর কোনও সিট খালি নেই। কিন্তু নেহাতই আমার খাতিরে তাকে এ্যাডমিশান টেস্টের একটা সুযোগ দেওয়া হল। মা নিয়ে গিয়েছিল। টিফিনের সময় বাইরে এসে দেখি মা চিন্তিত মুখে স্কুলের একচিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আর আমাদের মৌ মিসের পেছন পেছন টিচার্স রুম থেকে বেরিয়ে আসছে বাপাই। জানা গেল, বাপাইয়ের এ-বি-সি-ডি-র মধ্যেই মিসদের টিফিন এসে যাওয়ায় মৌ মিস নিজের ভাগের টিফিন থেকে একটা রসগোল্লা বাপাইকে অফার করেছিলেন। জবাবে সে গম্ভীর মুখে বলেছিল, তাকে খাইয়ে দিতে হয়। যাই হোক, খাওয়া দাওয়ার শেষে সে জল খেতে এসেছে মায়ের কাছে রাখা ওয়াটার বটল থেকে। পরীক্ষা যেমনই হোক, শেষ পর্যন্ত হেডমিসের বদান্যতায় সে ভর্তিই হয়ে গিয়েছিল স্কুলে।
তারপর একে একে কেজি স্কুল হাই স্কুল পেরিয়ে সে ভর্তি হল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। তারপর পড়াশোনা শেষ করে চাকরি জুটিয়ে চলেও গেল হায়দ্রাবাদ। এখন সে পাঁচ বছরের সফো।
সময় কত তাড়াতাড়ি কেটে যায়। আঠাশ বছর পেরিয়ে গেল সেই ছাল ওঠা গোলাপি পুঁটলির। এখন সে রীতিমতো জিরাফ। এবং কদিন আগে তার একটা ছাল ওঠা গোলাপি ছোট জিরাফ হয়েছে। আদর করে তার দাদার সঙ্গে মিলিয়ে ডাকনাম রেখেছি নিও। বাপাইবাবু আর বাপনবাবুর ছেলে নিওবাবু আর নিমোবাবু।
তা যাই হোক, আজকের দিনেই জন্মেছিলেন বাপাইবাবু। এমন জন্মদিন তার আরও ঘুরেফিরে আসতে থাকুক। আরও লম্বা হোক সে।
ওমনিস্কোপ
Homepage of Rohon Kuddus
Leave a Reply