“আরে সাব, আমি তো সেকেন্ড মেনেই সব পেয়ে যাচ্ছি। আপনার গণেশা টেম্পল। হাউস নাম্বার ফোর। ব্লু-হোয়াইট বিল্ডিং। আপনি শুধু শুধু ফার্স্ট মেন বলে যাচ্ছেন।”
মনে সন্দেহ দেখা দিল। তাহলে কি ফার্স্ট মেনের প্যারালাল ইউনিভার্সে সেকেন্ড মেন আছে? সেখানেও সবই এক – গণেশ মন্দির, নীল-সাদা বাড়ি? কিন্তু সে বাড়ির চারতলার শেষ ফ্ল্যাটের বাসিন্দা নিশ্চয় এই ভোর সাড়ে তিনটেতে উঠে ট্যাক্সিওলার সঙ্গে ফোনে তর্ক করছে না। সে নির্ঘাত তার বউ-বাচ্চা নিয়ে সুখে ঘুম দিচ্ছে। সকালে উঠে রোববারের বাজার সেরে এসে বলবে, “চল নিমো, পার্কে ঘুরে আসি।” একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। মরিয়া বললাম, “আপ জোরসে হর্ন বাজাইয়ে।” নৈশশান্তির দফরফা করে নীচ থেকে আওয়াজ এল বিদঘুটে হর্নের। বুঝলাম ট্যাক্সি আমার বাড়ির নীচেই এসে দাঁড়িয়েছে। ব্যাগপত্তর নিয়ে নেমে এলাম। গাড়ির ডিকিতে সব ভরে খাড়া হয়ে দাঁড়াতেই ট্যাক্সিওলা ব্যাজার মুখে বলল, “জলদি কিজিয়ে। আপনাকে এয়ারপোর্টে ছেড়ে আর একজনকে তুলে আনতে হবে।” ডিকি বন্ধ করে ট্যাক্সির পেছনের দরজা খুলে বললাম, “সকাল সকাল কালমেঘ খায়ে হো ক্যয়া? রেডি-ই তো হ্যায় হাম।” কায়দা করে বসে সশব্দে ট্যাক্সির দরজা বন্ধ করে বললাম, “চলিয়ে।” এবার চালক পেছন দিকে গলা বাড়িয়ে আমার পা দেখাল — “চপ্পল পহেনকে যায়েঙ্গে?” হে মাওলা! মোক্ষম সময়গুলোতে ট্যাক্সিচালক, অটোচালকদের আমার বিপক্ষে আপারহ্যান্ড পাইয়ে দিয়ে কী মজা পাও তুমি? কিন্তু আজ আমিও হটার পাত্র নই। আমার বাড়ির ঠিকানা নিয়ে প্রশ্ন। যে জায়গায় গত তিন বছর আছি, সেটা ফার্স্ট মেন নাকি সেকেন্ড, তার ফয়সালা হয়নি এখনও। সেই তর্কের দ্রুত নিষ্পত্তি করার ঝোঁকে এখন দেখছি ঘরে পরা হাওয়াই চটি পরেই চলে এসেছি। আমি একবুক নিশ্বাস নিয়ে শুরু করলাম – “তুমে পাতা হ্যায় হাম কাঁহা সে হ্যায়।” সে ব্যাটা একগাল হেসে বলে, “উচ্চারণ শুনে তো বঙ্গালি মনে হচ্ছে।” আমি তাতে বিন্দুমাত্র না দমে বললাম, “আপকো ভি দেখকে বিহারি লাগতা হ্যায়। লেকিন আপকা বুদ্ধি জবরদস্ত হ্যায়।” তারপর প্রত্যাঘাতের সুযোগ না দিয়ে আমি চালিয়ে গেলাম, “হাঁ, তো শুনিয়ে। হাম বাংলা সে হ্যায়। হামারা দিদি কো জানতা হ্যায়? দিদি ইয়ে হাওয়াই চটি পহেনকে লন্ডন ঘুম কে আয়া। তো হাম কিঁউ নেহি যা শকতে হ্যায়?” সে ব্যাটা বিহারি কিনা কে জানে, কিন্তু ভোম্বল জরুর – “আপকা সিস্টার ভি এ্যায়সে কাম কি থি? পুরা ফ্যামিলি চপ্পল পহেনকে ঘুমতা হ্যায় কা?” আমি এবার খাপ্পা হয়ে বললাম, “আরে আকাল কা দুশমন। সে সিস্টার নয়। আমাদের সিয়েম রে বাবা। মমতাদিদি। লেকিন ফ্যামিলি কা বাত হি উঠা, তো শুনো। মেরা মাদার, চেন্নাই কা আম্মা নেহি রে বাবা, মেরা খুদকা মা, হাওয়াই চটি পরকে, মানে পহেনকে বিয়েবাড়ি গয়া থা। হাম ইয়ে সব পরোয়া নেহি করতে হ্যায়।” তারপর উপসংহার টানলাম — “আংরেজ আগার বুট পহেনকে ভারত আ শাকতা হ্যায়, তো হাম চটি পহেনকে বিলাত কিঁউ নেহি যা শকতে হ্যায়?” ট্যাক্সিচালক কাঁধ ঝাঁকাল – “য্যায়সা আপকা মর্জি।”
ট্যাক্সিটা গলির মাথায় গেছে কি যায়নি, তাকে বোর্ড দেখালাম এবার – “দেখো হে। কবসে সেকেন্ড মেন বোল রাহে হো। আই এস টি ক্যয়া হোতা হ্যায়? সেকেন্ড?” সে গাড়িটা হলুদ বোর্ডের খুব কাছে নিয়ে গিয়ে মাথা নাড়ল, “পাশেই আর একটা ডান্ডা আছে না?” আমিও দেখলাম। কেউ গুটখা খেয়ে তেরছা ভাবে থুকেছে। কিন্তু আজ আমি মোটেও ছাড়বার মুডে নেই – “বো টেঁড়া ডান্ডা দো দিখ রাহা হ্যায়? উসকা আগে যো এস টি হ্যায়, বো নেহি দেখা? সেকেন্ড হোতা তো এন ডি নেহি রহতা?” সে এবার একটু চুপ করে থেকে বিড়বিড় করে বলল, “নোংরা বোর্ড কেউ সাফও করে না। আমার মতো বেচারি ট্যাক্সি ড্রাইভাররা ঝামেলায় পড়ে।”
আমার মনে তখন অন্য চিন্তা ঘুরছে। পায়ে হাওয়াই চটি পরে গাড়িতে উঠে তো পড়েছি। কায়রো পৌঁছে একটা মাপমতো জুতো কিনেও নেওয়া যাবে। কিন্তু প্লেনের এসিতে পা জমে বরফ হয়ে যাবে। ট্যাক্সিটা আরও দুশ মিটার এগিয়েছে কি এগোয়নি। আমি আচমকা চেঁচিয়ে উঠলাম, “রোককে।” আচমকা ব্রেক দিয়ে খেঁকিয়ে উঠল ট্যাক্সিওলা – “আবার কী হল?” আমি নিরীহ মুখ করে বললাম, “বিস্কুটের প্যাকেট।” সে দেখা গেল বেশ চালিয়াত। মৃদু হেসে বলল, “বিলেতে বিস্কুট তো পাওয়াই যায়।” আমি গাড়ির দরজা খুলে বেরোতে বেরোতে বললাম, “গণেশজি কা পরসাদ হ্যায়। যাত্রা কে লিয়ে শুভ হোতা হ্যায়। থোড়া রুকো। তুরন্ত লেকে আতা হ্যায়।”
দৌড়ে বাড়ির কাছাকাছি এসে মনে পড়ল ফ্ল্যাটের চাবি গাড়িতেই, ব্যাগের মধ্যে। আবার আরেক রাউন্ড দৌড়। তাড়াহুড়ো করে জুতোজোড়া একটা প্যাকেটে ঢুকিয়ে বেরোতে যাব, বসার ঘরের টেবিলে নজর গেল। পাশাপাশি পড়ে আছে আমার পাসপোর্ট, ডলারের খাম আর টিকিটের প্রিন্ট আউট।
টেকসিটি লে আউটের ফার্স্ট মেনের সমান্তরাল জগতের ঘুমন্ত সফো ফিক করে হেসে পাশ ফিরে শুলো।
9
February 17, 2017
whao