অ্যাডমিশান টেস্ট

আমি কেলাস ফোরে ওঠা ইস্তক বাপি-মা ঝামেলায় পড়েছিল, ক্লাস ফাইভে কোথায় আমার ভর্তি করা যায় সেই নিয়ে। যে ছেলের মুখচোখ থেকে প্রতিভা ঠিকরে বের হচ্ছে (যা কিনা নিজের সন্তান সম্পর্কে সকলেই ভেবে থাকেন), তাকে তো আর সাধারণ হাই ইস্কুলে পড়ানো যায় না। অবশ্য মা-বাপির দোষ দিই না। তখন হাওয়াটাই অমন ছিল। আমাদের পরিচিত সব বন্ধু-বান্ধবদের মা-বাবারও একই আলোচনা সবসময়। সবার এক রায় – ছেলে মানুষ করতে হলে রামকৃষ্ণ মিশন। অতএব চলো মন, রামকৃষ্ণ মিশন।

 

পুরুলিয়ার ফর্ম তোলা হল। নরেন্দ্রপুরেরও। ভালো ছেলের জন্যে ভালোতম ইস্কুল। কিন্তু বাপি-মায়ের চালে একটু ভুল হয়ে গিয়েছিল। পুরুলিয়াতে সুযোগ পেতে গেলে রামানুজম, শেক্সপীয়ার আর রবি ঠাকুরের ক্লাস ফোর সংস্করণ দরকার হত। তাও আলাদা-আলাদা নয়, তিনজনের কম্বিনেশান চাই। প্রশ্ন যা হয়েছিল, সে আর কহতব্য নয়। অনেক পরে বুঝেছিলাম অঙ্কের ২-১টা প্রশ্ন ক্লাস এইট থেকেও ছিল। প্রশ্নকর্তাদেরই বা দোষ কী? ক্লাস ফোরের অ্যাডমিশান টেস্টের জন্যে ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়া দাড়ি-গোঁফ গজানো কিছু ছেলেও পরীক্ষা দিচ্ছে দেখা গেল। তাদের সাথে আসা অভিভাবকরাই জানালেন। আর আমি ক্লাস ফোরে পড়ি এবং ক্লাস ফাইভের জন্যে পরীক্ষা দিচ্ছি শুনে বেশ কয়েকজন অভিভাবক নিজেদের মধ্যে মুখ টিপে হাসাহাসি করছিলেন। হাসবেন না-ই বা কেন? তুমি যদি অনূর্ধ্ব বারোর কাউকে ধরে নিয়ে গিয়ে পার্থে ম্যাকগ্রা-ব্রেট লি-র সামনে দাঁড় করিয়ে দাও, তাহলে নাক তো ফাটবেই। সবাই থোড়াই শচীন? সংক্ষেপে পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন ঢ্যাঁড়া।

 

আর নরেন্দ্রপুর? আমার জীবনের অন্যতম একটা ভয়াবহ পরীক্ষা। পুরো পরীক্ষা হয়েছিল বাংলা মাধ্যমে। আর আমি পড়তাম সেন্ট টমাস কিন্ডারগার্টেন স্কুলে, যেখানে শুধু বাংলাটা বাংলায় পড়ানো হত। ফলত কিছুই লিখতে পারলাম না নরেন্দ্রপুরের ‘প্রবেশিকা পরীক্ষা’য়। তবে আমাদের ক্লাসে আমি সবথেকে ভালো বাংলা ছড়া লিখতাম। তাই একটা পাদপূরণের উত্তর করে এসেছিলাম। প্রশ্নে ১ম, ৩য়, ৫ম ইত্যাদি লাইনগুলো ছিল। বলা হয়েছিল মাঝের লাইনগুলো ভর্তি করতে। প্রথম লাইনটা ছিল – ‘খঞ্জনা নদীতীরে অঞ্জনা গাঁয়ে…’ আমি তার সাথে মিল রেখে নিজের লাইন লিখে এসেছিলাম ২য়, ৪র্থ আর ৬ষ্ঠ লাইনে। অনেক পরে, ক্লাস এইটে উঠে জেনেছিলাম, ঐ লাইনগুলো নাকি রবি ঠাকুরের লেখা। তা রবি ঠাকুরের এক লাইন আর রোহণ কুদ্দুসের এক লাইন এইভাবে সেই ছড়াটা কী দাঁড়িয়েছিল এখন আর মনে নেই। তবে আমি কখনও পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী বা রাজ্যপাল হয়ে গেলে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করব কোনওভাবে যদি সেই হারিয়ে যাওয়া সাহিত্যকীর্তি তাঁরা উদ্ধার করতে পারেন।

আরও একটা প্রশ্নের উত্তর করেছিলাম। জীবনবিজ্ঞানে ছিল – “বৃক্ক কাকে বলে?” অত নামী স্কুলের প্রশ্নপত্রে এমন ভুল দেখে আমি বেশ আশ্চর্য হয়ে প্রশ্নকর্তাকে শুধরে দিয়েছিলাম – “বৃক্ক নয়, কথাটা আসলে বৃক্ষ। গাছকে ভালো ভাষায় বৃক্ষ বলে।” কে জানে খাতা যিনি দেখেছিলেন তিনি কীভাবে এটা হজম করেছিলেন।

পরে অবশ্য নিজে এরকমই একটা আবাসিক প্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষার খাতা দেখতে দেখতে উপলব্ধি করেছি, আমার মতো লোকজন এ পৃথিবীতে কম নেই। যে কোনও কারণেই হোক, তারা নামী স্কুলগুলোতে পরীক্ষা দিতে আসে হোমওয়ার্ক না করেই। ফলে তাদের উত্তরপত্রগুলো তাদের অজান্তেই টিচার্স রুমে খোরাক হয়ে যায়। ১০০-তে ১ বা ২ পাওয়া ছেলেদের খাতা দেখে আমার আজও নিজের নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের পরীক্ষার কথা মনে পড়ে। আমি নির্ঘাত শূন্য পেয়েছিলাম। আর সত্যি বলতে কী বুকের মধ্যে সেই না পারার পুরানো ব্যথাটা এখনও চিনচিন করে ওঠে।

 

তা ধান ভানতে শিবের গীত ছেড়ে আসল কথায় আসি। ব্যাপারটা এরকম দাঁড়াল, নরেন্দ্রপুর আর পুরুলিয়ার পর আমার জন্যে বাকি রইলো পুরো পশ্চিমবাংলার মধ্যে আর দুটো ইস্কুল – বাগনান উচ্চ বিদ্যালয় আর বাঙালপুর হাই স্কুল। বাপি আর মায়ের মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা। মানে মাথা খারাপ হওয়ার আগের অবস্থা আর কী। এমন সময় ত্রাতার ভূমিকায় এগিয়ে এল রাঙাকাকু। জানা গেল, রাঙাকাকুর এক বন্ধু একটা হোস্টেল তৈরি করেছেন খলতপুর নামে একটা গ্রামে। আমার পড়াশোনার জন্যে আদর্শ জায়গা। রাঙাকাকুর কাছ থেকে রাস্তা জেনে নিয়ে বাপি একদিন অ্যাডমিশান টেস্টের ফর্ম তুলে নিয়ে এল।

ফিরে এসে বাপি তো প্রশংসায় পঞ্চমুখ। খুব ভালো পরিবেশ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ানো হয়। তার সাথে আরবী পড়ার ব্যবস্থাও থাকবে। আর সাধারণ স্কুলের পঠনপাঠন তো আছেই। মুসলমান পরিবারের ছেলেদের জন্যে আদর্শ একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মা তবু গজগজ করতেই থাকে – “রামকৃষ্ণ মিশন তো হল না। দ্যাখো যদি এখানে রাঙাকাকুর সুপারিশে ঢুকে পড়তে পারো।”

 

আবার ফর্ম ফিল আপ? আবার ভর্তি পরীক্ষা? একটু ভয় পেলেও আমি নতুন উদ্যমে শুরু করলাম। তদ্দিনে স্কুলে রবার্ট ব্রুসের গল্পও পড়া হয়ে গেছে। রবার্টবাবুর প্রেরণা ছিল মাকড়সা আর আমার প্রেরণা রবার্টবাবু। তার ওপর এবার চেনা পিচে খেলা হবে। কারণ এবার আগে থেকেই জানা যে, বাংলায় প্রশ্ন আসবে। এমনকী মিশন কর্ত্তৃপক্ষ একটা ছাপা সিলেবাস দিয়ে দিয়েছেন। সেটা উলটে পালটে দেখে কে যেন বলল – “ক্লাস ফোরের সরকারি বইয়ের সিলেবাস এটা।” জয়তু সরকার! গ্রাম থেকে দাদাভাই ক্লাস ফোরের এক সেট ঝকঝকে বই পাঠিয়ে দিল। শুরু হল নতুন আর একরকম পড়াশোনা। ক্লাসের ইংরাজি হোমটাস্ক সামলে বাংলায় ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, অঙ্ক এবং অবশ্যই বাংলা। হাতে আর কটা মাত্র দিন সময়।

 

দুরুদুরু বুকে এক রবিবারের ভোরে উঠে কলকাতায় পরীক্ষা দিতে গেলাম। পার্ক স্ট্রীটের একটা বাড়ির দোতলায়। পরীক্ষা ভালোই হয়েছিল, অন্তত আমার মতে। বাড়ি ফিরে আসতে মায়ের তবু সন্দেহ যায় না। কারণ আগেও দুবার আমি বলেছিলাম ভালো পরীক্ষা হয়েছে। আমি ওসব কথায় কান না দিয়ে মাকে একটা সাধারণ জ্ঞানের তথ্য শোনালাম – “জানো তো মা, আমার পাশে একটা ছেলে পরীক্ষা দিচ্ছিল, তার নাম সাদ্দাম হোসেন।” উপসাগরীয় যুদ্ধ তার আগের বছরই শেষ হয়েছিল সম্ভবত।

মজাটা লক্ষ্য করেছ কি? ‘ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ’ বা ‘জিহাদ’ নাম দিয়ে যে বস্তুটা এখন বাজারে চালানো হয়, সেটা কিন্তু তখনও তার দাঁত-নখ নিয়ে ভারতে থাবা বসায়নি। তবু সাদ্দাম হোসেনের মুসলমান হওয়ার অপরাধে আমার স্কুলের কিছু বন্ধু আমার দিকে আঙুল তুলতে আরম্ভ করেছিল। টিভির খবরে প্যাট্রিয়ট মিসাইল একটা স্কাড মিসাইলকে ধ্বংস করছে – এই ফুটেজ আমার কাছে ছিল দারুণ রোমাঞ্চকর (যদিও সমুদ্রে তেল ছাড়ার ফলে মৃতপ্রায় সামুদ্রিক পাখিগুলোকে দেখে আমার মন খারাপ করত দারুণ)। এক কথায়, তখন উপসাগরীয় যুদ্ধটা আমার কাছে টিভিতে দেখা রামায়ণ বা মহাভারতের যুদ্ধের থেকে বেশি কিছু নয়। কিন্তু রামায়ণ বা মহাভারতের যুদ্ধের থেকে উপসাগরীয় যুদ্ধের একটা তফাত নিজে থেকেই আমার কাছে ধরা দিল। রামায়ণ বা মহাভারত সিরিয়াল দেখার সময় তুমি খুব স্বাভাবিকভাবে তোমার ফেভারিট বেছে নিতে পারো। ৯ বছরের একজন বাচ্চা ছেলের কাছে রাম বা অর্জুন নিশ্চিত হিরো; রাবণ এবং দুর্যোধন বা দুঃশাসন হেরো ভিলেন। কিন্তু সাদ্দাম? নাকি বুশ? কে রাম? কে রাবণ? এতদিনে নাহয় আমার কাছে স্পষ্ট – দু দলই রাবণ। কিন্তু আজ থেকে ১৬-১৭ বছর আগে কে আমায় বুঝিয়ে দিত তখন? তাই স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়াকালীন দুজন সহপাঠী যখন আমার আর সাদ্দাম হোসেনের মুসলমান হওয়ার রিস্তা খুঁজে বের করে আমায় নিয়ে হাসাহাসি করতে আরম্ভ করল, তখন অবচেতনেই তাদের কিছু না বলতে পেরে আমি সাদ্দামকে আমার টেম্পোরারি হিরো বেছে নিলাম। এমনকী অপারেশান ডেজার্ট স্টর্মে নাস্তানাবুদ সাদ্দামের প্রতি আমার করুণাও হয়েছিল বেশ। আর তারপরই আল আমীন মিশনের অ্যাডমিশান টেস্টে একজন সাদ্দাম হোসেনকে খুঁজে বের করার ব্যাপারটায় বেশ মজা পেয়েছিলাম। এই আনন্দ একজন হিরোকে খুঁজে পাওয়ার মতো নয়। এই আনন্দকে বরং আমার বয়সোচিত চাঞ্চল্যের সাথে সাজুয্য রেখে হারিয়ে যাওয়া মার্বেল খুঁজে পাওয়ার সাথে তুলনা করা যেতে পারে।

 

তা যা বলছিলাম। দিন যায়। একদিন হঠাৎ করে মিশন থেকে অ্যাডমিট এল ওরাল একজামের। তার মানে লিখিত পরীক্ষায় আমি উতরে গেছি। বাব্বাঃ! এ্যাদ্দিনে শিকে ছিঁড়ল। মা বুঝিয়ে দিল, এবার একটা ইন্টারভিউ, মানে মৌখিক পরীক্ষা হবে, যা কিনা আমাদের স্কুলের ওরাল একজামিনেশানের মতো। তার জন্যে আর কলকাতা নয়। যেতে হবে এক্কেবারে আল আমীন মিশনে। খলতপুর, যা কিনা তখনও আমি জানতাম খড়গপুর। নিয়ে যাবে ফুলকাকু। কারণ বাপির কী একটা দরকারি কাজ আছে ঐ দিন। রবিবারও বড়দের কী এত কাজ থাকে কে জানে। তুমিই বলো, আমিও তো রবিবার ‘জাঙ্গল বুক’ বা ‘টম এ্যান্ড জেরি’ বাদ দিয়ে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি। কই আমি কি বলেছি “আজ কার্টুন দেখব, ইন্টারভিউ দিতে যাব না?”

যাই হোক, একটা নতুন জামা-প্যান্ট পরে রওনা দিলাম ফুলকাকুর সাথে। ঐ যে রাস্তা বললাম, আমতা-উদয়নারায়ণপুর-বাঁশতলা। বাস বদলে, রাস্তা বাতলে পৌঁছলাম বেলা দুটোয়। মৌখিক পরীক্ষার সময় দেওয়া ছিল ১টা ৩০। আমার তো ভয়ে পেটের মধ্যে হাত-পা ঢুকে যাওয়ার উপক্রম। এ্যাদ্দূর এসে যদি ফিরে যেতে হয়? ফুলকাকুর ওপর দারুণ রাগ হতে লাগল। কী দরকার ছিল উদয়নারায়ণপুরে রিকশাওয়ালার সাথে দরদাম করে সময় নষ্ট করার? না হয় ২ টাকা বেশি নিত? কিন্তু এখন যদি সময়ে না আসতে পারার জন্যে এখান থেকে ফিরিয়ে দেয় আমাদের? সত্যি, বড়দের আর কবে বোঝাতে পারব সময়ের মূল্য!

8

No Comments Yet.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *