গুরদীপ সিংয়ের মরা-বাঁচা

সুষমা স্বরাজ-এর মহাশ্বেতা দেবীকে নিয়ে ট্যুইটটি আমার নজরে এনেছিলেন শামিমদা। ব্যাপারটা সত্যি কিনা সেটা দেখব বলে ট্যুইটারে গিয়ে দেখলাম বিতর্কিত ট্যুইটটা নেই। না থাকাই স্বাভাবিক, ভুল তথ্য দিয়ে পোস্টটি সত্যিই হয়ে থাকলে সেটা ডিলিট করে দেওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। যাই হোক, যেটা দেখতে গিয়েছিলাম সেটা না দেখতে পেয়ে মন্ত্রীজির অন্যান্য ট্যুইট দেখতে লাগলাম।
লক্ষ করলাম, একটা আপডেটে বলা হয়েছে, গুরদীপ সিং নামের এক ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড হতে চলেছে ইন্দোনেশিয়ায়। ভারত সরকার (বলা ভালো বিদেশমন্ত্রীর দপ্তর) চেষ্টা করছেন, সেটা রুখে দেওয়ার। দারুণ কৌতূহল হল, একটা মানুষকে কেন ইন্দোনেশিয়ায় গিয়ে মরতে হবে? ভারতেই মরার হাজার এক রকম তরিকা আছে। যাই হোক, গুগল করে দেখলাম, বছর বারো আগে ৩০০ গ্রাম মাদক নিয়ে ইন্দোনেশিয়া এয়ারপোর্টে ধরা পড়েছিল কীর্তিমান। ইন্দোনেশিয়ার আদালত তাকে গুলি করে মারার হুকুম দিয়েছিলেন। তারপর যা হয়, ছোট কোর্ট, মাঝারি কোর্ট, বড় কোর্ট ইত্যাদি করেও লাভ হয়নি। বছর খানেক এদিক ওদিক চক্কর কাটার পরেও সেই মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। কিন্তু তারপরও ২০০৫ থেকে এতগুলো বছর লোকটাকে না মেরে কেন যে জেলে বন্দী করে রেখেছিল, সেসব আর লেখা নেই। আর একটা ওয়েবসাইটে পড়লাম, ইন্দোনেশিয়ায় গুরদীপের সঙ্গেই এই উইকএন্ডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে আরও তেরোজন মানুষের। কেউ পাকিস্তানের, কেউ নাইজেরিয়ার, কেউ জিম্বাবোয়ের, কেউ বা আবার ইন্দোনেশিয়ারই। এক জায়গায় এ-ও পড়লাম, পুলিশ মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল গুরদীপকে — যদি সে লিখে দেয় তাকে পাকিস্তানের লোকটা ফাঁসিয়েছে, তবে সে ফায়ারিং স্কোয়াড থেকে বেঁচে যাবে। প্রাণ বাঁচাতে তা করেছিলও সে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
এটা পড়তে পড়তে মনে পড়ে গেল ওয়াকিন ফিনিক্সের ‘রিটার্ন টু প্যারাডাইস’ ছবিটির কথা। সেটা অবশ্য মালয়েশিয়ার প্রেক্ষাপটে ছিল। তিন বন্ধু উদ্দাম এক ছুটি কাটিয়েছিল সেই ট্রপিকাল স্বর্গে। বাকি দুই বন্ধু ভ্যাকেসান শেষ করে আমেরিকা ফিরে যায়। কিন্তু ফিনিক্স থেকে যায় গবেষণার খাতিরে (সম্ভবত বাঁদর বিষয়ক কিছু)। বছর দুয়েক পরে এক আইনজীবী, বাকি দুই বন্ধুকে খুঁজে বের করে খবর দেয়, এই দুজন ফিরে আসার পরে কোনও কারণে পুলিশ ওদের সেই ফেলে আসা ক্যাম্পে হানা দেয়। সেখানে বেশ ভালো পরিমাণে মাদক পাওয়া গিয়েছিল। ফিনিক্স যেহেতু সেই ক্যাম্পে তখনও ছিল, তাই তার ওপর পুরো দোষটা পড়ে। অত মাত্রায় মাদক রাখার জন্যে তার মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। সপ্তাখানেকের মধ্যেই সেটা কার্যকর করা হবে। কিন্তু বাকি দুই বন্ধু যদি তাদের দায় স্বীকার করে, তাহলে অপরাধের মাত্রা তিনজনের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে এবং শাস্তি লঘুতর হবে। দুই বন্ধুই মালয়েশিয়া ফিরে আত্মসমর্পণ করলে তিন বছর করে কারাদণ্ড হবে। একজন ফিরলে ছ বছর। যাই হোক, সেই বন্ধুরা অন্য বন্ধুর প্রাণ বাঁচাতে ফিরে যায় মালয়েশিয়ার। শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল, সেটা ছবিটা যারা দেখেনি, তাদের জন্যে আর খোলসা করলাম না।
কিন্তু গুরদীপের খবরটা পড়ে সেদিন থেকেই বেশ কৌতূহলী ছিলাম। গুরদীপ কি বাঁচবে? পররাষ্ট্র দপ্তর কি শেষমেশ সফল হবেন? লোকটা সত্যিই দোষী না নির্দোষ, সে প্রশ্নে যাচ্ছি না। কিন্তু ভারতে মানুষটার একটা পরিবার আছে — স্ত্রী, বাচ্চা-কাচ্চা। তাদের ওপর দিয়ে (বিশেষত তার স্ত্রীর ওপর দিয়ে) কী ঝড়টা যাচ্ছে, সেটা ভাবার চেষ্টা করছিলাম। সেই মুন্নাভাইয়ের কথায়, একটা টাইম বোমের মতো ব্যাপার। তুমি জানো মরতে চলেছ। প্রথমে দিন, তারপর ঘণ্টা, তারপর মিনিট-সেকেন্ড। তারপর সব খালাস। কার একটা লেখায় পড়েছিলাম, এক ফাঁসির আসামীর মৃত্যুদণ্ডের দিন ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু তার স্ত্রী তার সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারছে না। কারণ লোকের বাড়ি কাজ করে চেয়ে-চিন্তে কোনও রকমে দিন চলে তাদের। অতদূর আসার মতো রাহাখরচ জোগাড় করা সে বেচারির পক্ষে সম্ভব হয়নি। শেষমেশ দেখাই হল না স্বামী-স্ত্রী-র, ফাঁসি হয়ে গেল। গুরদীপেরও ফাঁসি হয়ে গেলে তার পরিবার অতদূর পাসপোর্ট-ভিসা-টিকিট খরচের চক্করে পড়ে শেষবারের মতো তাকে দেখতে পাবে না।

রোজকার মতো আজ সকালেও গুরদীপের আপডেট চেক করতে গিয়ে দেখলাম লোকটা শেষমেশ বেঁচেই গেছে। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে কাজ হয়েছে। গুরদীপের বাড়ির লোকজনের ছবি দেখলাম — হাসিমুখে মিষ্টি খাচ্ছে সবাই। বিদেশের এক জেলের কোণে থাকুক, এক যুগ বাড়ি না ফিরুক, বেঁচে তো আছে। সত্যি মানুষের মন কী আজব পদ্ধতিতে কাজ করে। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। কেউ জানে না, সে কবে বাড়ি ফিরবে। কিন্তু তার স্ত্রী বলছে, “ফিরলে আর বিদেশে যেতে দেব না।”
হয়তো লোকটা বদমাশই। বেঁচে ফিরলেও আবার হয়তো আর কাউকে ওই বিষের নেশায় ফাঁসানোর চেষ্টা করবে। বা হয়তো একবার ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে থেকে (আক্ষরিক অর্থেই, ফায়ারিং স্কোয়াডের নিয়ে গিয়ে ফেরত আনা হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ) বেঁচে ফিরে মানুষটা বদলেই যাবে। সময়ই এর উত্তর দেবে। কিন্তু তার পথ চেয়ে বসে থাকা এক নারীর মুখে একদিনের জন্যে হলেও তো হাসি ফিরল। বাচ্চাগুলো তো তবু আশ্বস্ত হল, তারা পিতৃহারা নয় এখনও। আর ওদিকে একটা মানুষের জীবন বাঁচিয়ে কয়েকজনের প্রাণভরা শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা তিনি অর্জন করেছেন, তাই দৈনন্দিন হাজারটা টেনশান আর ঝামেলার মধ্যে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও নিশ্চিত একবুক তাজা বাতাস নিলেন সুষমা স্বরাজ।
ভাবতে অবাক লাগে, চারদিকে ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট এইসব খুশিগুলো খুঁটে এনে আমরা আনন্দে থাকার চেষ্টা করছি না, রুদ্ধশ্বাস এমন সব সত্যি ঘটনা থেকে বেঁচে থাকা খুঁজে নিচ্ছি না। আফটার অল, জীবন মানে তো সত্যি সত্যিই জি-বাংলা নয় রে বাবা।

13
10 Comments
  • kausik bhaduri
    July 30, 2016

    পড়লাম। জানতাম না খবরটা।

    • rohonkuddus@gmail.com
      July 30, 2016

      🙂

  • Aritra Sanyal
    July 30, 2016

    Kudos rohon

    • rohonkuddus@gmail.com
      July 30, 2016

      থ্যাংকিউ ভায়া। 🙂

  • প্রকল্প ভট্টাচার্য
    July 30, 2016

    শুনেছিলাম, এবং ধরেই নিয়েছিলাম যে ও অপরাধী তাই শাস্তিভোগ করতেই হবে। কিন্তু ওর বেঁচে যাওয়ার খবরে স্বস্তি পেলাম, কারণ আমি মৃত্যুদণ্ডের পক্ষপাতী নই। কিন্তু এমন মানবিক ভাবেও ভাবতে পারিনি। বড্ড ছুঁয়ে গেল লেখাটা!

    • rohonkuddus@gmail.com
      July 30, 2016

      থ্যাংকিউ প্রকল্পদা। 🙂

  • SK MUJAFFAR HOSSAIN
    July 30, 2016

    খুব ভালো লাগলো, মানুষটা বেঁচে আছে শুনে। সে যেই হোক, যেমনই হোক, মৃত্যুদণ্ড যেন না হয়।।

    • rohonkuddus@gmail.com
      July 31, 2016

      মৃত্যুদণ্ড নিয়ে বিতর্ক অন্তহীন। চলছেই।

  • দীপঙ্কর চৌধুরী
    July 31, 2016

    গুরদীপের কাহিনী মন ছুঁয়ে গেল। আপনার কলমের গুণে আরও।

    • rohonkuddus@gmail.com
      August 1, 2016

      থ্যাংকিউ স্যর। 🙂

Leave a Reply to দীপঙ্কর চৌধুরী Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *