আমার আর সব সরলরৈখিক গল্পের মত এই গল্পেরও দুটো বিন্দু আছে। শুরু আর শেষটা বলে নিই আগে। তারপর মাঝের রেখাংশটা পেশ করা যাবে।
ফেসবুকে আপডেট দিয়েছিলাম – ‘আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই…’ কিছুক্ষণ পরে দেখি দেবজ্যোতিদা পাদপূরণ করেছেন – ‘গভীর পকেটে বোমা মেরে তোর ঈশ্বরী বেচবোই।’ (যারা জানেন না, ঈশ্বরী দেবজ্যোতিদার গল্প সংকলন।) সৃষ্টিসুখ থেকে প্রকাশিত বইগুলোর প্রত্যেকটার জন্যেই যদি এমন চরণযুগল যোগাড় করা যায়, তাহলে আর বই বেচতে পাঠক-ক্রেতার পায়ে ধরতে হয় না। অফিস থেকে ফেরার পথে এইসব চিন্তা করতে করতে মুচকি মুচকি হাসছিলাম। (ও হ্যাঁ, অফিসে বসেই ফেসবুক করছিলাম, আপনি করেন না? কেন করেন না? অফিসে ব্লকড তো? আমার অফিসেও ব্লকড। কিন্তু আমার ল্যাপটপে আসে। কী করে? রীতিমত নিজের পয়সায় কেনা ডঙ্গল লাগিয়ে ফেসবুক করি। হ্যাঁ, অফিসের টাইমেই করি। কেন? আপনি অফিসে বসে চা-কফি খাওয়ার নাম করে এদিক-ওদিক যান না? আমি চা-কফি খাই না, ফেসবুক করি। চা-কফি খাই না বললাম, বিশ্বাস হল না তো? ছাড়ুন, ফার্স্ট ব্র্যাকেটে আপনার মত থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বারের সঙ্গে তর্ক করার কোনও ইচ্ছা নেই।)
যাই হোক, রাস্তায় একবার দিদির দোকানে দাঁড়ালাম আলু-পটল কিনতে। সঙ্গে টম্যাটো আর কাঁচা লঙ্কা। ডেরায় ফিরে সেসব নামিয়ে রেখে দেবজ্যোতিদাকে ফোন করলাম। ফেসবুকে ওনার অসাধারণ লাইনটা জাস্ট অজুহাত। এমনিই ফোন করলাম। যারা গল্প লেখেন, তাঁদের ফোন করতে বেশ আরাম। তাঁরা মজার মজার কথা বলে থাকেন। যেমন আজ দেবজ্যোতিদা বললেন, “রুটি দিয়ে ছোলার ডাল খাচ্ছি।” আমি সুড়ুত করে জিভ-মুখ-নাল সামলে বললাম – “কিন্তু সে তো ঠান্ডা না হলে ঠিক জমে না। ওখানে কি ঠান্ডা এখন?” ওদিক থেকে উত্তর এল – “না। এখানে এখন গরম নয়।” তারপর একটু থেমে মুখের খাবারটা গলায় চালান করে বললেন – “আসলে ছোলার ডালের মত কিছু না হলে রুটি খাওয়াটা কষ্টের।” আমারও। এইজন্যেই যারা গল্প লেখেন, তাঁদের এত ভালো লাগে। কী মিল! কী মিল! যাই হোক, দেবজ্যোতিদার ছোলার ডাল খাওয়ার কথা শুনে আমারও কিছু ভালোমন্দ খেতে ইচ্ছে হল। কিন্তু তখন রাত পৌনে দশটা। ছোলার ডাল ভিজিয়ে তো রাখা নেই। সত্যি বলতে কী, আস্তানায় ছোলার ডালই নেই। আমার সম্বল আলু-পটল। তাই উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম – “আলু-পটলের একটা ভালো দেখে রেসিপি দিন তো।” অন্য সময় হলে দেবজ্যোতিদার মত রান্না নিয়ে জ্ঞান দেওয়ার লোক কমই পাওয়া যায়। কিন্তু তখন উনি ছোলার ডাল সাবাড় করতে ব্যস্ত। তাই বাধ্য পতির ভান করে বললেন – “দাঁড়াও, তোমার মিঠুদিকে ফোনটা দিই। ও পটলের অনেক রান্না জানে।”
মৌসুমীদি ফোনটা নিয়ে একথা-সেকথার পর বলল – “পটলের দোলমা ফ্যান্টাসটিক হয়। কিন্তু সে তোমার জন্যে দারুণ শক্ত।” শক্ত! আমার জন্যে? মৌসুমীদি তো আর জানেন না, আমি প্যারিসে জন্মালে কবিতালিখিয়ে না হয়ে রাঁধুনি হতাম। তাই বুক ঠুকে বললাম – “হোক শক্ত। তবু তুমি বলো। দোলমা না হয়ে দলমাই হোক, কিন্তু হাম ট্রাই করেগা।” আমার উৎসাহ দেখে মৌসুমীদি বলল। যা বুঝলাম, তা অনেকটা এরকম।
প্রথমে ছুরি দিয়ে হালকা করে পটলের গা থেকে পাতলা করে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হবে। এই কাজটা আমি অবশ্য আমার ভেজিটেবল পিলার দিয়েই করতে পারি। তারপর পটলের মুখের দিকে আধ ইঞ্চি মত কেটে নিয়ে সেদিক থেকে একটা ছোট চামচের পেছন দিক দিয়ে পটলের ভেতরের সবকিছু বের করে আনতে হবে। তারপর পটলের পেটে পুর ঢোকাতে হবে। মাংসের কিমা রান্নার পুর, বা রান্না করা মাছের ভালো করে কাঁটা বেছে নিয়ে তার পুর, বা… ইত্যাদি, ইত্যাদি প্রভৃতি। আমি জানতে চাইলাম, সয়াবিনের পুর চলবে কিনা। জানা গেল, ভালো করে রান্না করে তারপর কুচি কুচি করে সয়াবিনগুলো কেটে পুর দেওয়া যেতেই পারে। যাই হোক, পটলে এই পুর ভর্তি করে (পুরো ভর্তি নয়, খানিকটা খালি রাখতে হবে) কাটা মুখটা ময়দা মাখা দিয়ে ভালো করে বন্ধ করে দিতে হবে। এভাবে বেশ কয়েকটা পটলের (আমি একা আছি, তাই ছ-সাতটাতেই কাজ চলা উচিত) নুনছাল ছাড়িয়ে, মুখ কেটে, পুর ভরে, মুখ বন্ধ করে বাইরের গাটা হাল্কা করে চিরে দিতে হবে।
তারপর তেল, পেঁয়াজ, টম্যাটো, গরম মশলা ইত্যাদি একসঙ্গে কষে নিয়ে একটু ঠিকঠাক গ্রেভি বানিয়ে তাতে পটলগুলো ছেড়ে দিতে হবে। পরিমাণ মত জল-টল মিশিয়ে নিতে হবে। পটলের পেটভর্তি করে পুর না দেওয়ার কারণ এই সময় ভেতরের পুর আয়তনে বাড়বে, তাই ঠেসে ঢোকালে পেটে ফেটে পুরো ছড়িয়ে যাবে। আর পটলের গা সামান্য চিরে দেওয়ার কারণ বাইরের ঝোল ভেতরে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকে বেশ মাখো মাখো একটা অভিস্রাবণ ঘটাবে। সব শুনে-টুনে আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম – “এই রাত দশটায় আর দোলমা খেয়ে কাজ নেই। আমি বরং পটল আলুই বানিয়ে নিই, যা পারি।” মৌসুমীদি ভালোমানুষ, তাই আমায় একদিন দোলমা খাওয়ানোর নেমন্তন্ন করল। (আমার নেমন্তন্ন ভাগ্য এদিক থেকে দারুণ ভালো। সবাই বেশ ঘন ঘন নেমন্তন্ন করে ফেলে। সেটা ব্যাঙ্গালোরে থাকি, সহজে বাংলায় যেতে পারব না, এই কারণে কিনা খতিয়ে দেখতে হবে। অবশ্য নুন খেয়ে নমকহারামি করা ঠিক হবে না। মৌসুমীদির বাড়ি বইমেলার সময় একবার ঢুঁ মেরে এসেছিলাম। দারুণ সব জিনিস খাওয়া হয়েছিল। সে গপ্পো আরেকদিন শোনাব।)
যাক গে, মোটমাট ব্যাপার যা দাঁড়াল – এটা আমার গল্পের প্রথম বিন্দু।
শেষের বিন্দুটা আর একটা কথোপকথনের। ফোনে নয়, ফেসবুকে। দোয়েলপাখিকে একটা লেখার জন্যে তাগাদা দিতে গিয়ে হল। (হুঁ হুঁ বাবা! সম্পাদকেরও সম্পাদক থাকে। দোয়েলপাখি আর সবাইকে তাড়া লাগায় লেখার জন্যে, কিন্তু আমি দোয়েলপাখির থেকে লেখা আদায় করি। অবশ্য সেও আমার থেকে লেখা নিয়ে থাকে। কিন্তু সেসব এখানে উল্লেখ না করাই ভালো, তাহলে লেখাটা আর সরলরৈখিক থাকবে না। একটা ইনফাইনাইট লুপে ঘুরতেই থাকবে – আমি দোয়েলপাখির থেকে লেখা নিচ্ছি… দোয়েলপাখি আমার থেকে লেখা নিচ্ছে… আমি আবার… বুঝেছেন আশা করি।)
‘লেখা দিচ্ছি’ বলেই আবার উত্তর এল – “শুভকাজে বাধা পড়েছে। মা একটা ব্লেড আর জলের বোতল চাইছে। আমি বলে দিলাম আমি তো আর সুইসাইডাল নই যে ব্লেড জমাব।” তারপর একটু থেমে সে লিখল – “কিন্তু এই ভদ্রমহিলা রাত দশটার সময় এই দুইখান জিনিস একসাথে চায় ক্যান এটাও একটা প্রশ্ন বটে।” আমি আন্দাজ করতে চাইলাম – “হয়ত আরশোলার শুঁড় কাটবেন বলে ব্লেড চাইছেন।” ওদিক থেকে ধমক এল – “তারপর কি অজ্ঞান পোকাটার মাথা জল ঢালবে বলে জলের বোতলটা চাইছে? এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি লেখালেখি করো?” যারা আমার লেখা পড়েন, তাঁরা সবাই-ই জানেন, এই বুদ্ধি নিয়েই আমি লেখালেখি করি। একবার এক পত্রিকা-প্রতিপালক থাকতে না পেরে ডাক দিয়েছিলেন – “গল্পের গরু, এবার নিচে নামুন।” যাই হোক, সেসব সুখস্মৃতি অন্য কখনও ওগরানো যাবে।
একটু পরে ওদিক থেকে উত্তর এল – “এই নাও।” একটা পিডিএফ এসে পড়ল। এদিক থেকে উত্তর নেই দেখে আর একটু পরে খোঁচা এল – “গাছে তুলে মই কেড়ে নিয়ে হাওয়া!” এর ঠিক এক ঘণ্টা একুশ মিনিট পরে আমি উত্তর দিলাম – “আরে আমি পটল-আলু রান্না করছিলাম। ঘি দিয়ে।” লোভ দেখানোর চেষ্টা করলাম – “কখনও খেয়ে দেখেছ সে অমৃত?” ওদিক থেকে উত্তর এল – “প্রায়ই খাই।” ভদ্রমহিলা নির্ঘাত ‘ঘি দিয়ে’ রান্নার ব্যাপারটা মিস করে গেছেন। ঘি দিয়ে পটল-আলু রান্না সেই করতে পারে, যে গরু গাছে তুলতে তুলতে নিজেই গপ্পের গরু হয়ে গেছে। যাই হোক, দোয়েলপাখির ঐ মিস করে যাওয়া অংশটাই হল দেবজ্যোতিদার বিন্দু থেকে দোয়েলপাখির বিন্দুর মাঝের এক ঘণ্টা একুশ মিনিটের রেখাংশ (বা গল্পাংশ, যা বলবেন)।
বলা যাক।
রান্না শুরু করতে গিয়ে দেখলাম তেল অল্প আছে, তাই তেলের সঙ্গে নন্দিনী ঘি মিশিয়ে পটলের গা থেকে আলতো করে খোসা ছাড়িয়ে (পটলের দোলমা না খেতে পাওয়ার শোকে) টুকরো করে নিয়ে জিরে-মরিচ-নুন-হলুদ দিয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে একটুও জল যোগ না করে তরিবত করে পটল আলু রান্না করলাম।
গপ্পো শেষ।
নিচে ছবি দিলাম, অপূর্ব গন্ধটা শেয়ার করতে পারলাম না।
0
July 8, 2014
বাহ বাহ বেশ
July 8, 2014
শুভেচ্ছা জানবেন। 🙂
July 8, 2014
byapok post ! keep it up dear !
July 8, 2014
থ্যাংকু ইন্দিরাদি। 🙂
July 8, 2014
আজ্ঞে ঘি দিয়েই খেয়েছি বহুবার। ঘি-টা মিস করব কী করে! রাজস্থানে যে সাত দিনও থেকেছে, ওই বস্তুটি মিস করার সাহস বা সৌ/দুর্ভাগ্য তার হবে না! তবে ঘি দেওয়া আলু-পটলের তরকারি আমার মাতৃদেবীই খাইয়েছেন বহুবার! তখনও যদিও তাঁর ব্লেড ও বোতলের প্রতি ফ্যাসিনেশন ছিল না!
July 8, 2014
এইজন্যেই গদ্যলিখিয়েদের এত ভালো লাগে। কী মিল! কী মিল!
July 8, 2014
amio jol chhaRa kumror chhokka ranna kore thaki, pray-i. ajke-o fridge-e rakhaachhe!!! angul-e nemontonno roilo. 😀
July 8, 2014
আঙ্গুলে কেন? আপনি যে নতুন ফ্ল্যাট কিনেছেন সাঁতরাগাছিতে, ওখানে হানা দেব। 😀
July 8, 2014
Tobe potol er kormata kora jete pare
July 8, 2014
ঠিকই। ওটার রেসিপিও মৌসুমীদির থেকে যোগাড় করতে হবে। 🙂
July 11, 2014
গল্পটার বিন্দু দুটোই ৷ তবে সে প্রথম বিন্দু থেকে বেরিয়ে হেলে-দুলে, রাস্তার মোড়ের দোকান থেকে এক কাপ চা খেয়ে, পরিচিত-অপরিচিত লোকজনের সাথে দুকথা কয়ে,
তারপর শেষমেশ শেষের বিন্দুতে গিয়ে মিশল ৷ সুতরাং এ গল্পটাকে সরলরৈখিক বলায় আমার ঘোর আপত্তি ৷ তবে ওই “হাম ট্রাই করেগা” লাইনটা সেরা ৷
July 11, 2014
ট্রাই-ই তো করে চলেছি আমরা। 🙂
August 3, 2014
এই যে কলকাতায় এসে ঘুরে গেলে ব্যস্তসমস্ত হয়ে দৌড়োদৌড়ি করে, এক ফাঁকে আসতে যদি তাহলে কী খাওয়াতাম জানো? আমার নিজের হাতে রান্না কোয়েলের বিরিয়ানি। সত্যি সত্যি। কদ্দিন আগেই ফেসবুকে ছবিও দিয়েছিলাম। দেখে নিও। আহা তার কি সুঘ্রান আর সুস্বাদ।
March 29, 2015
কোয়েলের বিরিয়ানি শুনে পাখিটার প্রতি মায়া হচ্ছে। :'(
July 4, 2015
দেখে সত্যিই লোভ হচ্ছে| আপনার সঙ্গে সম্মুখ সাক্ষাৎ ও পরবর্তী আড্ডায় চা-ফা না নিয়ে গরমাগরম রুটি আর ঘি দিয়ে আলু-পটলই নয় চলবে|
July 7, 2015
অপেক্ষায় থাকলাম। 🙂
July 4, 2015
ইনফিনাইট লুপ না বলে, ভিসিয়াস সাইকল ও বলা যায়। হামভি ট্রাই করেগা, রোহণ কু(ক)দ্দুস।
July 7, 2015
টেরাই পিলিজ। 😀
July 4, 2015
হাম, রাজস্থান, এইসব কথা শুনে একটা ঘটনা বলার লোভ সামলাতে পারলামনা । আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেদের সদলবলে রাজস্থান ভ্রমণ চলছে। একটা কেউ ভালো হিন্দি জানেনা। স মেড ইন উলুবেড়িয়া । আমার শ্যালক বাসে উঠে একটা লেডিজ সিটে বসে গেছে। স্থানীয় একজন তাকে বলছে ‘ ইয়ে লেডিজ সিট হ্যায়” । আমার শালা তাকে বোঝাতে গেল আমাদের সাথেও লেডিজ আছে, তার মুখ দিয়ে বেরোল ” হামভি লেডিস”।। বাসে হাসির রোল, সেই ব্যক্তিটি তখন চেঁচাচ্ছে ” মোছুঁওয়ালা বাঙগালী বাবু আপনকো লেডিস বোলতা…” ।
July 7, 2015
হা হা হা… 😀
July 5, 2015
তুমি একলা খেয়ো না ঐ পেট ছেড়ে যাবে, পাগল হলে নাকি তোমার আর যে কী হবে……
July 7, 2015
সে তো কবেই হজম হয়ে গেছে।
July 5, 2015
Asadharon apnar randhan-potutwo o bhojon-bilasita….
July 7, 2015
Thank you 🙂