একটি আদ্যোপান্ত রেসিস্ট পোস্ট

সকাল ছটা পনেরোয় বেরিয়ে সাড়ে সাতটার মধ্যে এয়ারপোর্টে। তারপর না তো চেক-ইনে কোনও লম্বা লাইন, না ইমিগ্রেশানে কোনও বাজে প্রশ্ন, না সিকিউরিটি চেকে কোনও ঝামেলা। এমনকী কোমরের বেল্টটা পর্যন্ত খুলতে বলল না এমন মোলায়েম মেজাজ ছিল মামাদের। সব মিটে যাওয়ার পর ব্রেকফাস্ট সেরে দেখলাম হাতে তখনও ঘণ্টা দুয়েক সময়, গিয়ে ঢুকলাম একটা বইয়ের দোকানে। এরা জীবনেও কোনও বইয়ে ডিসকাউন্ট দেয় না, অথচ রাসকিন বন্ডের যে বইটা কিনলাম, তাতে কুড়ি পারসেন্ট ছাড় দিয়ে দিল। তখনই একটা আশঙ্কা গুড়গুড় করে উঠল মনে, সবকিছু এত ঠিকঠাক চলছে, ঝামেলাটা শুরু কখন হবে?

ঝামেলা শুরু হল দুবাইয়ে প্লেন বদলানোর পরে। কায়রো ফ্লাইটে উঠে ব্যাগ-ট্যাগ মাথার ওপর তুলে টয়লেট গেছিলাম। ফিরে দেখি, একটা হোঁতকা কালো লোক আমার সাধের উইন্ডো সিটে বসে। আমি শান্ত স্বরে বললাম, “ওটা আমার জায়গা।” সে দাঁত ছড়িয়ে বলল, “নো প্রবলেমা। ইউ ক্যান সিট অন মাইন।” আইল সিটটার দিকে হাত দেখাল সে। ইংরাজি উচ্চারণে মালুম হল তামিল। তাই হোঁতকা কালো বলাটা যদি রেসিস্ট মনে হয়, তাহলে আমি নাচার। এভাবে না বলে-কয়ে অন্যের জায়গায় বসে পড়ে ‘নো প্রবলেমা’ বলে বত্রিশ পাটি বের করলে তাকে ক্যাবলা হিপোও বলা যায়। যাই হোক, রাগটা হজম করে বসেই পড়লাম। ‘জাঙ্গল বুক’ দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু গুছিয়ে বসে শুরু করতে না করতেই দু চোখ জড়িয়ে এল ঘুমে।

ঘুম ভাঙল অনেক পরে। প্লেন তখন মধ্যগগনে।

“স্যর শুনছেন?”

চোখ খুলে দেখি স্মিতহাস্য এয়ার হোস্টেস। হাতে একটা ট্রে।

“আপনার লাঞ্চ। এশিয়ান হিন্দু ভেজ মিল।”

বলে দিত হত না। ট্রে-র এককোণে দেখতে পাচ্ছি স্টিকারে গোটা গোটা করে লেখাই আছে। মনে হল স্বপ্ন দেখছি। দুঃস্বপ্ন। বদমাশ ট্রাভেল এজেন্সি! পই পই করে বলে দেওয়া সত্ত্বেও সেই একই ভুল করে বসে আছে। তবুও এই সংকটে মাথা স্থির রাখা দরকার। মধু মাখিয়ে বললাম, “কিন্তু আমার এই মিলের দরকার নেই। তোমাদের রেগুলার নন ভেজ মিল দিলেই চলবে।”

“তা তো বললে চলবে না স্যর। এই মিল আপনার নামে বুক করা হয়েছে। তাছাড়া ফ্লাইটও পুরো ভর্তি। আপনি এই ভ্যাদভ্যাদে সবজি-ভাত না খেলে আমি এখন এগুলো কার মুখে গিয়ে ঠুসব?”

বলাই বাহুল্য, অনুবাদের সময় আমি ‘রিডিং বিটুইন দ্য লাইনস্‌’ ব্যাপারটা করেছি। যাই হোক, মোদ্দা কথা হল, তিনি এই মিল ফেরত নিতে পারবেন না। আমি মরিয়া চেষ্টা করলাম।

“দ্যাখো বাপু, না তো আমি হিন্দু, আর না আমি ভেজিটেরিয়ান, অতএব কেন আমায় এই মিল খেতে বলছ? ধর্মে সইবে?”

“সে যুক্তিতে দেখলে তুমি এশিয়ান তো বটে। তাহলে?” এয়ার হোস্টেসটি চোখ দিয়ে মিটিমিটি হাসছে।

আমি তখন খচ্চরের মতো খুঁট পেতে বসে গেছি। “কে বলেছে আমি এশিয়ান?” সেই ললনার বোঁচা নাকের (জানি এটাকেও রেসিস্ট মন্তব্য হিসাবে ধরা হবে, কিন্তু ক্লিওপেট্রার (সেই ক্লিওপেট্রা, যাঁর নাক সামান্য খাঁদা হলে ইতিহাসের গতি বদলে যেতে পারত) দেশে যাচ্ছি আর মিশরগামী এক চিনি মহিলার (এটাকে রেসিস্ট মন্তব্য হিসাবে ধরা যেতে পারে। আমাদের জন্যে জাপানি, ভিয়েতনামি, চিনি, তাইওয়ানি সব্বাই এক।) নাকের দিকে নজর যাবে না, তাও কি হয়?) দিকে তাকিয়ে অম্লানবদনে মিথ্যে বলার চেষ্টা করলাম, “দ্যাখো, আমি আরবি বলছি।” একটু দম নিয়ে নমুনা দেখালাম, “তুমি কেমন আছ? আমি ভালো আছি। কিন্তু আমার কাকার গত এক সপ্তা ধরে কান কটকট করছে।” চওড়া হাসলাম, “দেখলে? আমি আসলে মিশরের লোক।” (যদিও কায়রো এয়ারপোর্টে আমায় একবার মিশরীয় বলে ভুল করায় এক পুলিশকে একহাত নিয়েছিলাম।)

ভেবেছিলাম ধরতে পারবে না, কিন্তু মাথা নেড়ে অঙ্কের মিসের মতো গম্ভীর গলায় বলল, “সরি স্যর, এটা শুনে একেবারেই আরবি মনে হল না।”

আমি গম্ভীর মুখে বললাম, “এটা আসওয়ান এলাকার ডায়ালেক্ট। গত দু হাজার বছর ধরে ওখানে এই আরবিই চলছে।”

এবার সে হেসেই ফেলল। “ভেজ খেতে তোমার একেবারেই ভালো লাগে না। তাই না?”

ধরা পড়ে গিয়ে আমি কাঁচুমাচু মুখে তাকালাম।

“সরি, আমি এখন কিছু করতে পারব না। কিন্তু আমি তোমায় এক্সট্রা একটা ড্রিংক্স দিয়ে যাব।”

“একটায় হবে না, দুটো।”

আমার হাতে ট্রে-টা ধরিয়ে দিয়ে সে গেল ড্রিংক আনতে। এবার চোখে পড়ল এশিয়ান হিন্দু ভেজ মিল স্টিকারের পাশে আর একটা স্টিকারে লেখা আছে খানেবালার নাম আর সিট নাম্বার। আর সুব্রমানিয়াম, এইটিন জি। এতক্ষণে মাথায় এল আমি কালো হোঁতকাটার জায়গায় বসে আছি আর তাই ওর নিরামিষ খাবার আমার ঘাড়ে এসে পড়েছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, লোকটা হাঁ করে ঘুমোচ্ছে। মেনুতে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, মেন কোর্সে আছে পনির, সাদা ভাত আর বেগুনের তরকারি। আর উচ্চবাচ্য না করে দুটো সফট ড্রিংক আর একটা ফ্রুট জুস সহযোগে ভালো মানুষের মতো খেয়ে মুখ-টুখ মুছে ফেললাম।

আধ ঘণ্টা পরে সাধারণ নন ভেজ পরিবেশনের সময় সেই তামিল লোকটি তার হিন্দু ভেজ মিল না পেয়ে প্রত্যাশিত ভাবেই চেল্লামেল্লি শুরু করল। সামাল দিতে পূর্বোল্লেখিত এয়ারহোস্টেসটি তাকে কিছু বোঝাতে যাচ্ছিল, আমি মাঝখান থেকে নাক গলিয়ে নিরীহ মুখে বললাম, “আসলে আমি তোমার জায়গায় বসেছি তো, তাই ভুল করে তোমার খাবারটা আমায় খেতে হয়েছে।” জোঁকের মুখে নুন পড়া ব্যাপারটা এতদিন বইয়ে পড়া ছিল, এবার চাক্ষুষ দেখলাম। কায়দা করে আমায় জায়গাটা হাতানো হয়েছিল, থাকো এবার না খেয়ে। এয়ারহোস্টেসটি আমার দিকে কৃতজ্ঞ হেসে পরের সারিতে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে তার কল্যাণে আরও এক গেলাস ফ্রুট জুস আমার কপালে জুটেছিল। কায়রো নামার পরে প্লেন থেকে বের হওয়ার সময় সে মাথা নেড়ে মিষ্টি হাসল, “নাইস টু মিট ইউ। থ্যাংকিউ।” আমিও দেঁতো হাসলাম, “প্লেজার ওয়াজ অল মাইন।” হঠাৎ ঘাড়ের কাছে আওয়াজ এল, “হঃ!” ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম থমথমে মুখে হোঁতকা কালো লোকটা (যাকে ক্যাবলা হিপোও বলা যায়) পাশ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।

20
6 Comments
  • Nina
    July 13, 2016

    Uff!! Dila grandi Mephistopheles ! Yak yak 💃💃💃💃😆

    • rohonkuddus@gmail.com
      July 13, 2016

      ইয়াক! ইয়াক!

  • সূর্যনাথ ভট্টাচার্য
    July 14, 2016

    খুব ভালো। শুরুটা হল গল্পের মতো…

    • rohonkuddus@gmail.com
      July 14, 2016

      🙂

  • Subarna Pal
    July 24, 2016

    Darun story r tor lekha asadharon..😊😊

    • rohonkuddus@gmail.com
      July 24, 2016

      থ্যাংকিউ থ্যাংকিউ 😀

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *